সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকিং নিয়ম উপেক্ষা করে দেওয়া এসব ঋণ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির প্রতিচ্ছবি। যা মূলত ‘ব্যাংক ডাকাতি’।
সর্বশেষ হিসাব বলছে, জনতা ব্যাংকের মোট ঋণের প্রায় ৬৬ শতাংশই খেলাপি, যার পরিমাণ ৬৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই বিপুল অর্থের দায়ে থাকা ব্যবসায়িক ও শিল্পগ্রুপগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, অ্যানন টেক্স গ্রুপ, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, রানাকা গ্রুপ, গ্লোব জনকণ্ঠ, রতনপুর গ্রুপ ও সিকদার গ্রুপ। এই গ্রুপগুলোর কাছে ৫৩ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা আটকে রয়েছে।
জনতা ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতির শুরুটা হয় বিসমিল্লাহ গ্রুপের মাধ্যমে আর সবচেয়ে বড় অঙ্কের ঋণ যায় বেক্সিমকো গ্রুপের কাছে, যার পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এ গ্রুপটির মালিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।
গত ১৫ বছরে জনতা ব্যাংকের এই জালিয়াতি ও অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হিমশিম খাচ্ছে। এসব ঘটনায় একাধিক অনুসন্ধান টিম কাজ করলেও কার্যকর অগ্রগতি হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে বর্তমানে দুদক উপ-পরিচালক মো. আল-আমিনের নেতৃত্বে একটি বিশেষ টিম বিগত এক দশকের বেশি সময়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির পৃথক অনুসন্ধান শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।
অনুসন্ধান টিম ইতোমধ্যে জনতা ব্যাংক সংক্রান্ত সব ঋণের নথিপত্র চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। এর মধ্যে কিছু নথি দুদকের কাছে পৌঁছেছে। প্রাথমিক যাচাইয়ে দেখা গেছে, কিছু জালিয়াতির ঘটনায় আগেই মামলা ও চার্জশিট হয়েছে। সে কারণে ওই বিষয়গুলো বাদ দিয়ে টিম নতুন অনিয়মগুলো আলোচনায় রেখেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, জনতা ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়ে বিভিন্ন প্রভাবশালী গ্রুপ জালিয়াতি ও পাচার করলেও দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুদকের মামলা ও চার্জশিটের প্রমাণ থাকলেও মূল কারিগরদের আড়ালে রাখার কৌশল দেখা গেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবার আশা করছি দুদকের অনুসন্ধান টিম স্বাধীনভাবে কাজ করে প্রকৃত কুশীলবদের আইনের আওতায় আনবে এবং ব্যাংক ঋণের ক্ষতিপূরণসহ রাষ্ট্রের অনুকূলে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাবে।
বড় ডাকাত বেক্সিমকো, সাথে আছে ৮ গ্রুপ
জনতা ব্যাংক ঋণ জালিয়াতির সবচেয়ে আলোচিত কেলেঙ্কারি বিসমিল্লাহ গ্রুপের বিরুদ্ধে। গ্রুপটি প্রায় ১,২০০ কোটি টাকা জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত, যার মধ্যে শুধু জনতা ব্যাংকের তিনটি শাখা থেকেই নেওয়া হয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। ২০১২ সালে সংঘটিত এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে মামলা ও চার্জশিট দাখিল করেছে। তবে এখন পর্যন্ত ঋণের অর্থ আদায় হয়নি। বরং সুদসহ এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১,১০০ কোটি টাকা।
তথ্য অনুযায়ী, বিসমিল্লাহ গ্রুপ জনতা ব্যাংকসহ পাঁচটি ব্যাংক থেকে নেওয়া মোট ঋণের বড় একটি অংশ বিদেশে পাচার করেছে। প্রধান আসামি খাজা সোলেমান চৌধুরী পরিবারসহ বিদেশে পলাতক। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এই জালিয়াতি ঘটলেও সেই দিকটি দীর্ঘদিন আড়ালেই থেকে গেছে।
সবচেয়ে বড় ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের বিরুদ্ধে, যার মালিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। শুধুমাত্র জনতা ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকেই গ্রুপটি পেয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ। অথচ ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো একটি গ্রুপকে এত বিশাল অঙ্কের ঋণ দেওয়ার নিয়ম নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেক্সিমকোর চাহিদামতো ঋণ অনুমোদনের জন্য দিলকুশা শাখার ক্ষমতা বাড়ানো হয়। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রুপটির দায় ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা; এক বছরে তারা আরও ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করেছে। এসব ঋণের বড় অংশই খেলাপি বা খেলাপির পথে। নানা কৌশলে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে খেলাপির অপবাদ এড়ানো হলেও প্রকৃতপক্ষে অর্থ ফেরত আসেনি। এ ছাড়া রপ্তানির আড়ালে প্রায় ৪৫৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে বেক্সিমকোর বিরুদ্ধে।
এসব অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় দুদক একাধিক মামলা করেছে গ্রুপটির বিরুদ্ধে, যার মধ্যে কিছু মামলায় সালমান এফ রহমানের নাম আছে।
জনতা ব্যাংক থেকে জালিয়াতরা শুধু ঋণ নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, অন্য ব্যাংকের খেলাপি ঋণও জনতা ব্যাংককে কিনতে বাধ্য করার উদাহরণ রয়েছে। যেমন নজরুল ইসলাম মজুমদারের মালিকানাধীন নাসা গ্রুপের ১২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংক কিনে নেয়। পরে নতুন করে আরও ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে এখন গ্রুপটির দায় দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি, যার পুরোটাই খেলাপি।
জনতা ব্যাংকের আরেক প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতা এস আলম গ্রুপ। আওয়ামী লীগ আমলে সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত এ গ্রুপটির কাছে ব্যাংকের মোট ঋণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১,২০০ কোটি টাকা ইতোমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে এবং আরও বিপুল অঙ্কের ঋণ রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়।
তদন্তে উঠে এসেছে, পণ্য আমদানির আড়ালে জনতা ব্যাংক থেকে নেওয়া প্রায় ৭০০ কোটি টাকা পাচার করেছে এস আলম গ্রুপ। শুধু খেলাপি নয়, গ্রুপটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ঋণ গ্রহণের অভিযোগেও জড়িত। যদিও এ পর্যন্ত জনতা ব্যাংক সংক্রান্ত জালিয়াতিতে এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে গ্রুপটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে।
এনন টেক্স গ্রুপের বিরুদ্ধেও রয়েছে বড় ধরনের ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ। তারা জনতা ব্যাংক থেকে ৫,৭৬৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার বড় অংশ দেশের বাইরে পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ। কিছু অর্থ ‘ডামি ফ্যাক্টরি’ দেখিয়ে ব্যয় দেখানো হলেও মূলত জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রে ভুয়া কোম্পানি খুলে এলসি (ঋণপত্র) জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাত করে তারা।
এ গ্রুপটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইউনুছ বাদলের নেতৃত্বে পরিচালিত জালিয়াতির পরিমাণ সুদ-আসলে বেড়ে এখন ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তেও মানি লন্ডারিং ও ঋণ জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এরপরও, অবিশ্বাস্যভাবে গ্রুপটির ৩,৩৫৯ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হয়।
শেষ পর্যন্ত গত ৩ জুন দুদক প্রায় ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এনন টেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ইউনুছ বাদল, জনতা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুছ ছালামসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।
ক্রিসেন্ট গ্রুপ জনতা ব্যাংক কেলেঙ্কারির অন্যতম আলোচিত নাম। অর্থ আত্মসাৎ, প্রতারণা, জাল কাগজপত্র তৈরি এবং অর্থপাচারের সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে এ গ্রুপের বিরুদ্ধে। জনতা ব্যাংক থেকে তারা মোট ৫,০৪০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে রিমেক্স ফুটওয়্যারের নামে ১ হাজার ৭০৮ কোটি, ক্রিসেন্ট লেদার ১ হাজার ২৯৬ কোটি, রূপালী কম্পোজিট ১ হাজার ২৩৯ কোটি, লেক্সাকো লিমিটেড ৫১৪ কোটি, ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ ২৩১ কোটি ও গ্লোরি অ্যাগ্রোর নামে ৪২ কোটি টাকা।
তদন্তে উঠে এসেছে, গ্রুপটি ভুয়া রপ্তানি বিল দেখিয়ে প্রায় ৫২২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে এবং হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এসব ঘটনায় ২০২২ সালে গ্রুপের চেয়ারম্যান এম. এ. কাদেরসহ একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা ও চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।
জনতা ব্যাংক থেকে জালিয়াতরা শুধু ঋণ নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, অন্য ব্যাংকের খেলাপি ঋণও জনতা ব্যাংককে কিনতে বাধ্য করার উদাহরণ রয়েছে। যেমন নজরুল ইসলাম মজুমদারের মালিকানাধীন নাসা গ্রুপ। এ গ্রুপের ১২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংক নিয়মিত অবস্থায় কিনে নেয়। পরে নতুন করে আরও ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে এখন গ্রুপটির দায় দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি, যার পুরোটাই খেলাপি।
অন্যদিকে গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার প্রথমে সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। ২০১২ সালে জনতা ব্যাংক সেই ঋণ কিনে নেয়, এরপর আরও নতুন ঋণ দেয়। বর্তমানে এ গ্রুপের মোট ৮০০ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়েছে।
এ ছাড়া আরও তিনটি গ্রুপ রয়েছে যাদের ঋণ পুরোপুরি খেলাপি অবস্থায় আছে। রানাকা গ্রুপের ঋণের প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা, রতনপুর গ্রুপের ১ হাজার ৩০০ কোটি ও সিকদার গ্রুপের ৮৩০ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে।
নথিপত্র অনুযায়ী, এসব গ্রুপের ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
দুদকের মহা-পরিচালক মো. আক্তার হোসেন এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি সংক্রান্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখতে দুদকের একাধিক টিম কাজ করছে। অনেকগুলো অভিযোগ রয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় দুদকে জমা হলেও বিষয়বস্তু প্রায় এক। ওই অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে তাতে আগের অনুসন্ধান বা তদন্তকাজ সংযুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে।’
‘জনতা ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ যদি পৃথকভাবে পরিচালিত হয়ে থাকে, তাহলে দুদকের অনুসন্ধান টিম আইন ও বিধি অনুসারে কাজ শেষে করে প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেবে। সে অনুযায়ী কমিশন ব্যবস্থা নেবে’, বলেন আক্তার হোসেন।