রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার তিন দিন পেরিয়ে গেলেও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ)-এর হিমঘরে পড়ে থাকা ছয়টি মরদেহ এখনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। অগ্নিদগ্ধ মরদেহগুলো এতটাই পুড়ে গেছে যে স্বাভাবিক গঠন, মুখমণ্ডল বা পোশাকের কোনো চিহ্নই অবশিষ্ট নেই। এমন পরিস্থিতিতে তদন্তকারী সংস্থা ও চিকিৎসকেরা মরদেহ শনাক্তকরণের জন্য ডিএনএ (DNA) টেস্টের ওপরই সম্পূর্ণ ভরসা রাখছেন।

চিকিৎসকরা বলছেন, অগ্নিদগ্ধ মরদেহে সাধারণত আঙুলের ছাপ থাকে না এবং চেহারা বিকৃত হয়ে যায়। তবে দাঁত তুলনামূলকভাবে আগুনে বেশি টিকে থাকে। এর কারণ হলো দাঁতের বাইরের স্তরে থাকা এনামেল মানবদেহের সবচেয়ে শক্ত উপাদান। ফলে অনেক সময় দাঁতের অভ্যন্তরে থাকা পাল্প টিস্যুতে জীবিত কোষের ডিএনএ রক্ষা পায়, যা শনাক্তকরণে সহায়ক হয়ে ওঠে।

তবে, যদি কোনো মরদেহের দাঁত অতিরিক্ত পুড়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে যায় বা ডেন্টাল স্যাম্পল নেওয়ার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে মরদেহের হাড়ের ভেতরের অংশ—অর্থাৎ বোন ম্যারো থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করা হবে। এরই মধ্যে মরদেহের সম্ভাব্য স্বজনদের কাছ থেকে চুলের গোড়া, নখ বা গালের ভেতরের কোষ (বুকাল সেল) সংগ্রহ করে অভিভাবক-সন্তান ডিএনএ মিলন পদ্ধতিতে শনাক্তের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

‘প্লেনের নাক’ ঢুকেছে সিঁড়িতে, দুই পাখায় পুড়েছে শিশুদের দুই ক্লাসরুম

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, এখনো পর্যন্ত অজ্ঞাত ছয়টি মরদেহের পরিচয় নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ নমুনা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. মো. সায়েদুর রহমান জানান, এখন পর্যন্ত কিছু ডিএনএ নমুনা দেওয়া হয়েছে। আরও যারা নিখোঁজ রয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি অনুরোধ— সিআইডির মালিবাগ কার্যালয়ে গিয়ে নমুনা দিন। তা হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডিএনএ মিলিয়ে মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হবে।

রাজধানীর সরকারি একটি মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক বলেন, ডিএনএ শনাক্তকরণে দাঁত অনেক বড় ভূমিকা রাখে। যদি দাঁত না থাকে, তখন আমরা হাড়ের অভ্যন্তরে থাকা বোন ম্যারো কিংবা অন্যান্য কোষীয় নমুনা ব্যবহার করি। এটি সময়সাপেক্ষ, কিন্তু নির্ভুল।

নিখোঁজ পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ নমুনা দেওয়ার অনুরোধ

ডিএনএ পরীক্ষা ও এর নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মমতাজ আরা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডিএনএ পরীক্ষাকে আমরা আজ বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিজ্ঞানসম্মত শনাক্তকরণ পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করি। বিশেষ করে অগ্নিদগ্ধ বা বিকৃত মরদেহের পরিচয় নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ডিএনএ টেস্টই একমাত্র নির্ভুল সমাধান হয়ে ওঠে। দেশে বর্তমানে এ প্রযুক্তি রয়েছে এবং যথাযথভাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার মাধ্যমে শতভাগ নির্ভরযোগ্য ফলাফল পাওয়া সম্ভব।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই মুহূর্তে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ কিংবা উত্তরার কোনো বেসরকারি হাসপাতালে মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষার্থী বা কর্মচারীদের মরদেহ নেই। অজ্ঞাতনামা ছয় মরদেহ সংরক্ষিত রয়েছে ঢাকার সিএমএইচ মর্গে। তার মধ্যে কয়েকটি মরদেহ এতটাই বিকৃত যে ছেলে না মেয়ে বোঝারও উপায় নেই। চিকিৎসকেরা এসব মরদেহ থেকে দাঁতের অংশ সংগ্রহ করেছেন এবং ফরেনসিক ইউনিট ও সিআইডির ডিএনএ ল্যাবরেটরিতে বিশ্লেষণের জন্য পাঠানোর কাজ শুরু হয়েছে।

এ ছাড়া, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতেও একই কথা জানানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সিএমএইচ মর্গে বর্তমানে রাখা ছয়টি মরদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যে এসব মরদেহ থেকে ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সিআইডি ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ বিশ্লেষণ করা হবে।

শিগ‌গিরই ঢাকায় পৌঁছাবে ভারতের অগ্নিদগ্ধ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার-নার্স

সিআইডির ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল হাতে আসতে সময় লাগবে কমপক্ষে ৭ থেকে ১০ দিন। আগুনে পোড়া মরদেহ শনাক্তে দাঁত ও হাড় সবচেয়ে কার্যকর নমুনা। অতীতেও সিএমএইচ ও ঢাকা মেডিকেলে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে আগুনে পুড়ে যাওয়া বহু মরদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

ডিএনএ টেস্টের জন্য ১১ স্বজনের নমুনা সংগ্রহ করেছে সিআইডি

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া মরদেহগুলোর পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষা শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। নিহতদের স্বজনদের কাছ থেকে ইতোমধ্যে ১১টি ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষ পুলিশ সুপার (ফরেনসিক) শম্পা ইয়াসমীন।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ পর্যন্ত সিএমএইচে থাকা অজ্ঞাত পরিচয়ের ১১টি খণ্ড থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। একইসঙ্গে, ১১ জন সম্ভাব্য দাবিদারের কাছ থেকেও নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব নমুনা আমাদের সিআইডি ডিএনএ ল্যাবে বিশ্লেষণাধীন রয়েছে।

শম্পা ইয়াসমীন আরও জানান, পুরো প্রক্রিয়াটি আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে, অত্যন্ত সতর্কতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিচালনা করা হচ্ছে, যাতে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি বা ভুল না হয়। শনাক্তের ক্ষেত্রে তথ্যের নির্ভুলতা ও স্বচ্ছতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘এটা একটি মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা। যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন, আমরা তাদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। আমরা জানি, এই দুঃসময়ে পরিবারগুলো কতটা উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন পার করছেন—স্বজনের খবর না পেয়ে চরম উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তায় রয়েছেন।’

‘দ্রুততম সময়ের মধ্যেই পরিচয় শনাক্তের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার চেষ্টা চলছে, যাতে কোনো পরিবারকে বেশি সময় অপেক্ষা করতে না হয়।’

পড়ে আছে শিশুদের ব্যাগ-বই-খাতা, বাতাসে পোড়া গন্ধ 

সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের ডিআইজি মো. জামশের আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতকাল (মঙ্গলবার) সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল থেকে প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করেছি এবং রাতেই ল্যাবে নিয়ে এসেছি। অগ্নিদগ্ধ হওয়ায় মরদেহগুলো খণ্ড-বিখণ্ড অবস্থায় রয়েছে। এখন শনাক্তের একমাত্র উপায় হচ্ছে ডিএনএ টেস্ট।

তিনি জানান, এখন পর্যন্ত ১১ জন স্বজন যেমন— পিতা-মাতা, ভাইবোনসহ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন। এই নমুনাগুলো পরীক্ষা করে নিহতদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে। প্রতিটি মরদেহের অংশ থেকে প্রোফাইল তৈরি করে, তা স্বজনদের প্রোফাইলের সঙ্গে ম্যাচ করানো হবে।

ডিএনএ পরীক্ষায় কত দিন সময় লাগবে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেহেতু নমুনা অনেকটাই পুড়ে গেছে, তাই এটি প্রাপ্ত স্যাম্পলের মানের ওপর নির্ভর করছে। সাধারণত আমরা দুই সপ্তাহ ধরে কাজ করি। যদি নমুনা ভালো হয়, তাহলে হয়তো কিছুটা দ্রুত ফলাফল পাওয়া সম্ভব।

বিকট শব্দের পর আগুন, মুহূর্তেই ঝলসে যায় আমার মুখ

তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, বর্তমানে কতজন নিহত হয়েছেন, সেটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ অনেক দেহাংশ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পাওয়া গেছে। কারও হাত, কারও হাড়— এসব থেকে শনাক্ত করা কঠিন। তাই ডিএনএ রিপোর্টই চূড়ান্ত পরিচয় নিশ্চিত করবে।

আহত-নিহতদের তালিকা তৈরিতে করা হয়েছে কমিটি

এদিকে, হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ এবং আহত, নিহত ও নিখোঁজদের নাম-ঠিকানাসহ তালিকা তৈরির জন্য ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে মাইলস্টোন কলেজ কর্তৃপক্ষ। অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলমকে সভাপতি করে গঠিত এই কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন— উপাধ্যক্ষ (প্রশাসন) মো. মাসুদ আলম, প্রধান শিক্ষিকা খাদিজা আক্তার, কো-অর্ডিনেটর লুৎফুন্নেসা লোপা, অভিভাবক প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান মোল্লা (শিক্ষার্থী- যাইমা জাহান, চতুর্থ শ্রেণি) এবং দ্বাদশ শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী— মারুফ বিন জিয়াউর রহমান ও মো. ভাসনিম ভূঁইয়া প্রতিক। কমিটিকে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সরাসরি ঘটনাস্থল পরিদর্শন, সংশ্লিষ্ট পরিবারদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং নিশ্চিত তথ্য যাচাই করে তালিকা প্রস্তুত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল মাইলস্টোন, নিহতের সংখ্যা গোপনের অভিযোগ

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কমিটির প্রতিবেদনটি শুধু অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার জন্য নয়, প্রয়োজনে সরকার, উদ্ধারকারী সংস্থা ও অন্যান্য সহায়তাকারী কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ইতোমধ্যে অধ্যক্ষের স্বাক্ষরে কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপন ই-মেইলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী কাজ শুরু করেছে সদস্যরা।

এ ছাড়া, দুর্ঘটনার সার্বিক দিক, উদ্ধার ও চিকিৎসা সহায়তা, অবকাঠামোগত ক্ষতি এবং নিরাপত্তা ঘাটতির বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণের জন্য আলাদাভাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা কাজ করছেন।

মৃত্যুর বিভ্রান্তি এড়াতে মাইলস্টোনে হচ্ছে কন্ট্রোল রুম

বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি এড়াতে ক্যাম্পাসে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন ও শিক্ষা উপদেষ্টা।

এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, গতকাল স্কুল পরিদর্শনের সময় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দুজন উপদেষ্টা স্কুল ক্যাম্পাসে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপনের নির্দেশ দেন। এই কন্ট্রোল রুম থেকে প্রতিদিন নিহত ও আহতের সঠিক সংখ্যা জানানো হবে এবং তা কলেজ রেজিস্ট্রারের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।