বাংলাদেশে সামরিক বাহিনির প্রশিক্ষণ বিমানের দুর্ঘটনার ঘটনা নতুন কিছু নয়। কিন্তু ২০২৫ সালের ২১ জুলাই ঘটে যাওয়া সর্বশেষ এফ-৭ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ফের নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দক্ষতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে।

সেদিন চট্টগ্রামের ভাটিয়ারি এলাকায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফ-৭ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। পাইলট অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান। বিমানটি ফ্লাইটের কিছুক্ষণ পরেই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যায়। দুর্ঘটনার পরপরই উদ্ধার কার্যক্রম চালানো হয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা তদন্ত করছে। কিন্তু তদন্ত চলছে—এই উত্তরটা এই মুহূর্তে আর যথেষ্ট নয়।

‎এর আগে, একই মডেলের এফ-৭ বিমান ২০১৮, ২০১৯, ২০২১ ও ২০২৩ সালেও বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রতিবারই একইরকম বিবৃতি এসেছে—তদন্ত চলছে। কিন্তু সেই তদন্তের কোনো প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে—যেহেতু পূর্বেও একই ধরনের বিমান ক্র্যাশ করেছে, তাহলে কেনো সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে যথাযথ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?

‎বিমান বাহিনীর কাছে অবশ্যই প্রতিটি দুর্ঘটনার পরিপূর্ণ তথ্য, ফ্লাইট রেকর্ড, এবং ব্ল্যাকবক্স বিশ্লেষণের রিপোর্ট থাকার কথা। তাহলে এই তথ্য ও অভিজ্ঞতা থেকেও প্রতিকারহীনতা কেন?

‎এফ-৭ বিমান চীনা প্রযুক্তির একটি পুরনো ডিজাইনের জঙ্গি বিমান, যা মূলত সোভিয়েত মিগ-২১-এর ভিত্তিতে তৈরি। এটি ১৯৭০-৮০ দশকে ডিজাইন করা হয় এবং দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে ব্যবহার হয়ে আসছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর কার্যক্ষমতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে।

‎বলা হয়ে থাকে, এসব বিমানের যন্ত্রাংশ পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। এমনকি রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক দেশ ইতোমধ্যে এ ধরনের বিমানগুলো বাতিল করেছে কিংবা সীমিত করেছে এর ব্যবহার। তবুও বাংলাদেশে এগুলো এখনও সক্রিয় প্রশিক্ষণ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে—এ সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক?

‎২১ জুলাইয়ের দুর্ঘটনার দিন দেশের রাজনীতিও উত্তপ্ত ছিল। বিএনপি এবং সরকারবিরোধী জোটের রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং হরতালকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। এমন পরিস্থিতিতে বারবার সামরিক শক্তি প্রদর্শন কিংবা যুদ্ধবিমানের উড্ডয়ন অনেক সময় প্রতীকী শক্তি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে দেখা হয়।

‎তবে যখন এই ধরনের শক্তি প্রদর্শন জীবনহানির সম্ভাবনা তৈরি করে, তখন প্রশ্ন ওঠে—এটা কি কেবল লোক দেখানো? যদি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছাতেই এই বিমান ব্যবহার হয়ে থাকে, তবে সেটা কতটা গ্রহণযোগ্য?

‎প্রতিরক্ষা একটি রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কিন্তু প্রতিবার এক ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার পরও একই প্রতিক্রিয়া—‘তদন্ত চলছে’—এটি জনগণের প্রতি দায়িত্বশীলতার পরিচয় নয়। বিমান বাহিনী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এই দুর্ঘটনাগুলোকে শুধুই দুর্ঘটনা বলে এড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে না।

‎এখন সময় এসেছে—দায়িত্ব গ্রহণের, স্বচ্ছতা দেখানোর এবং মানুষের জান-মালের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার।