বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বিক্ষোভকারীদের প্রকাশ্য গুলি করার নির্দেশ ও তার পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যমটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টানা ১৫ বছর বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের ব্যাপক বিক্ষোভ-প্রতিবাদের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারত পালিয়ে যান। হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার আগে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা রক্তক্ষয়ী বিক্ষোভ ও সরকারের দমন-পীড়নে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত এবং ২০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)।
আল জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট (আই-ইউনিট) শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া ফোনালাপের অডিও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছে। এতে শেখ হাসিনার ওই অডিও যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে তৈরি করা নয়, সেটি নিশ্চিত হয়েছে আই-ইউনিট। এই পরীক্ষায় ভয়েস-ম্যাচিংয়ের মাধ্যমে ফোনালাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও শনাক্ত করা হয়েছে।
গত বছরের ১৮ জুলাই জাতীয় টেলিযোগাযোগ নজরদারি কেন্দ্র (এনটিএমসি) শেখ হাসিনার একটি ফোনালাপ রেকর্ড করে। এই কল রেকর্ডে শেখ হাসিনা তার এক সহযোগীকে বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘‘ইতোমধ্যে আমার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমি সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ্যে আদেশ দিয়েছি। এখন তারা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে, যেখানেই পাবে গুলি চালাবে। এটা নির্দেশ দিয়েছি। এ পর্যন্ত আমি তাদের থামিয়ে রেখেছিলাম... আমি শিক্ষার্থী নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছিলাম।’’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও আত্মীয় শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে ওই ফোনালাপে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে হেলিকপ্টার ব্যবহারের কথাও বলেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘‘যেখানেই জমায়েত দেখা যাবে, ওপর থেকে, এখন তো ওপর থেকেই হচ্ছে—কয়েক জায়গায় শুরু হয়ে গেছে। কিছু বিক্ষোভকারী সরে গেছে।’’
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ওই সময় বিক্ষোভকারীদের ওপর আকাশ থেকে গুলি চালানোর বিষয়টি অস্বীকার করলেও রাজধানীর পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শাবির শরীফ আল জাজিরার আই ইউনিটকে বলেন, হেলিকপ্টার থেকে আমাদের হাসপাতালের প্রবেশপথ লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়।
তিনি বলেন, আন্দোলনকারী আহত শিক্ষার্থীদের শরীরে গুলির অস্বাভাবিক ক্ষত দেখা গেছে। শাবির শরীফ বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর ছোড়া গুলি বিক্ষোভকারীদের কাঁধে অথবা বুকে ঢুকে যায় এবং সেগুলো শরীরেই থেকে গেছে। সেই সময় আমরা এই ধরনের অনেক রোগী পেয়েছিলাম। এক্স-রে করে আমরা হতবাক হয়েছি যে, শিক্ষার্থীদের শরীরে অনেক গুলি ছিল।
তবে শিক্ষার্থীদের ওপর কী ধরনের গুলি ব্যবহার করা হয়েছিল, তা নিশ্চিত হতে পারেনি আল জাজিরা।
আসামিপক্ষের বিরুদ্ধে এসব ফোনালাপ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হতে পারে। শেখ হাসিনা, তার কয়েকজন মন্ত্রী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা ও তার দুই সহযোগী কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আগামী আগস্টে তাদের বিচার শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
আন্দোলনের সময় এসব ফোনালাপ রেকর্ড করেছে শেখ হাসিনার নজরদারি সংস্থা এনটিএমসি। এই সংস্থাটি এর আগেও কেবল বিরোধী নেতাদের নয়, বরং হাসিনার রাজনৈতিক মিত্রদের ওপরও নজরদারি চালিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনা জানতেন তার কথোপকথন রেকর্ড হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘অনেক সময় অপর পক্ষ বলত, এই বিষয়ে ফোনে না বলাই ভালো। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলতেন, ‘‘হ্যাঁ, আমি জানি, আমি জানি, রেকর্ড হচ্ছে। কোনও সমস্যা নেই।’’
প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘তিনি (হাসিনা) অন্যদের জন্য গভীর গর্ত খুঁড়েছিলেন। এখন সেই গর্তে তিনি নিজেই পড়ে গেছেন।’’
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য সরকারি চাকরিতে বিশেষ কোটার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের জুনে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। হাইকোর্ট পুরোনো কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সেই সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এই কোটা ব্যবস্থা আওয়ামী লীগের সমর্থকদের প্রতি পক্ষপাতমূলক এবং যোগ্যতার চেয়ে পারিবারিক পরিচয়ই চাকরির ভিত্তি হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন।
১৬ জুলাই দেশের উত্তরাঞ্চলীয় শহর রংপুরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। জুলাই অভ্যুত্থানে তার মৃত্যুই আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
আল জাজিরার হাতে আসা আরেকটি গোপন ফোনালাপে শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে রংপুরে নিহত আবু সাঈদের ময়নাতদন্তের রিপোর্টের বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে চাপ দিতে শোনা যায়। ফোনে তিনি বলেন, ‘ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেতে এত দেরি কেন হচ্ছে? কে লুকোচুরি খেলছে? রংপুর মেডিকেল?’
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. রাজিবুল ইসলাম আল জাজিরাকে বলেন, পুলিশ তাকে পাঁচবার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বদলাতে বাধ্য করে, যাতে একাধিক গুলির ক্ষত থাকার তথ্য না থাকে।
তিনি বলেন, ‘‘তারা এমন রিপোর্ট চাইছিল যাতে লেখা থাকে, আবু সাঈদ ভাই পাথর নিক্ষেপে আহত হয়ে মারা গেছেন... কিন্তু তিনি পুলিশের গুলিতেই মারা গেছেন।’’
আবু সাঈদের মৃত্যুর ১২ দিন পর তার পরিবারকে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে হাজির করা হয়। প্রায় ৪০টি পরিবার সেখানে উপস্থিত ছিল। আর এসব পরিবারের কেউ না কেউ বিক্ষোভে নিহত হয়েছেন।
আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, আমাদের গণভবনে আসতে বাধ্য করেছিলেন হাসিনা। আমাদের আসতে বাধ্য করা হয়েছে। না এলে অন্যভাবে নির্যাতন করত।
অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা প্রত্যেক পরিবারের হাতে অর্থ তুলে দেন। আবু সাঈদের বোন সুমি খাতুনকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আপনাদের পরিবারকে ন্যায়বিচার দেব। শেখ হাসিনার এমন আশ্বাসের জবাবে সুমি বলেন, ‘‘ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশ গুলি করেছে। এখানে তদন্তের কী আছে? আমাদের এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে।’’
আল জাজিরাকে দেওয়া এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র বলেছেন, শেখ হাসিনা কখনও ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র’ ব্যবহারের কথা বলেননি এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে গুলি চালানোর নির্দেশও দেননি।
তিনি বলেন, এই ফোনালাপ খণ্ডিতভাবে নতুবা বিকৃত করে প্রচার করা হয়েছে অথবা দুটিই করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আবু সাঈদের মৃত্যুর তদন্তে সরকার ‘গভীর আন্তরিকতা’ দেখিয়েছে।