এমপিও শিক্ষকরা সাধারণত একটি সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতায় থাকেন। অনেকেই শিক্ষকতা শুরু করেন মেধা ও আগ্রহ নিয়ে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে দেখা যায় অনেকে ধীরে ধীরে তাদের সেই মেধা, উদ্যম ও দক্ষতা হারিয়ে ফেলছেন। এর পেছনে বেশ কিছু সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত কারণ কাজ করে।

এমপিও শিক্ষকরা সাধারণত একটি সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতায় থাকেন। অনেকেই শিক্ষকতা শুরু করেন মেধা ও আগ্রহ নিয়ে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে দেখা যায়  অনেকে ধীরে ধীরে তাদের সেই মেধা, উদ্যম ও দক্ষতা হারিয়ে ফেলছেন। এর পেছনে বেশ কিছু সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত কারণ কাজ করে।
১. অনুপ্রেরণার অভাব:
এমপিও হওয়ার পর অনেকেই নিরাপত্তার অনুভূতিতে পড়ে যান। পেশাগত উৎকর্ষের জন্য তেমন কোনো পুরস্কার বা মূল্যায়ন পদ্ধতি না থাকায় অনুপ্রেরণা কমে যায়।
২. প্রশিক্ষণ ও বিকাশের সুযোগের অভাব:
নিয়মিত প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, গবেষণা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ না করলে দক্ষতা হ্রাস পায়। আত্মউন্নয়নের জন্য পেশাগত পাঠ্যক্রম বা শিক্ষাগত চর্চার অভাব।
৩. আর্থিক অস্থিরতা ও সীমাবদ্ধতা:
এমপিও বেতন কাঠামো অনেক সময় প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত নয়। অর্থনৈতিক চাপ ব্যক্তিগত ও পেশাগত মনোযোগ হ্রাস করে।
৪. জবাবদিহিতার অভাব:
শিক্ষকতা পেশায় পর্যাপ্ত মনিটরিং ও মূল্যায়নের অভাব থাকলে কর্ম উদাসীনতা দেখা দেয়। দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো ও রাজনৈতিক প্রভাব কাজের মান হ্রাস করে। পাঠদানের মান নিয়ে পর্যবেক্ষণ বা মূল্যায়ন হয় না।
৫. প্রযুক্তিগত অজ্ঞানতা ও নতুন শিক্ষণ কৌশল থেকে পিছিয়ে থাকা:
ডিজিটাল যুগে নতুন পদ্ধতি ও প্রযুক্তি সম্পর্কে অজ্ঞতা থাকলে শিক্ষক তার প্রাসঙ্গিকতা হারান।
৬. চ্যালেঞ্জের অভাব:
এমপিওভুক্তির পর চাকরি নিশ্চিত হয়ে যায়। দীর্ঘমেয়াদে কোনো প্রতিযোগিতা বা অগ্রগতির চাপ না থাকলে আত্মতুষ্টি জন্ম নেয়।প্রতিযোগিতা নিয়ে কাজ করতে তারা পিছিয়ে পরে। কারণ জবাবদিহিতা ও চাকরি চলে যাওয়ার ভয় নেই। 
৭. একঘেয়েমি ও অভ্যাসগত শিক্ষাদান:
একই ক্লাস, একই পদ্ধতি ও একই পাঠ বছরের পর বছর শেখানোর ফলে আগ্রহ হারিয়ে যায়। 
নতুন কিছু শেখা বা শেখানোর চেষ্টায় অনীহা আসে।
৮. পেশাগত উন্নয়নের সুযোগের অভাব:
প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কশপ, বা গবেষণায় অংশ নেওয়ার সুযোগ সীমিত বা অপ্রতুল। ফলে মেধা বিকাশের 
পরিবেশ তৈরি হয় না।
৯. আর্থিক ও সামাজিক সীমাবদ্ধতা:
এমপিও বেতন অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজন মেটাতে পারে না। বাড়তি চাপ ও হতাশা শিক্ষকের মানসিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে।
১০. ব্যক্তিগত উদ্যম ও দায়িত্ববোধের অভাব:
নিজের দায়বদ্ধতা ও আত্মউন্নয়নের অভাব থাকলে মেধা হ্রাস পায়। আত্মউন্নয়নের অভ্যাস না থাকলে, মেধা ক্ষয় হতে শুরু করে। পাঠ্যবইয়ের বাইরের জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনে আগ্রহ না থাকলে স্থবিরতা আসে। বহু বছর একই পরিবেশে একই পদ্ধতিতে কাজ করলে মনযোগ ও আগ্রহ কমে যায়।
১১. দলাদলি ও গ্রুপিং:
প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তি ,আদর্শ ও নিজস্ব চিন্তা নিয়ে দলাদলি বা গ্রুপিং তৈরি করে প্রতিষ্ঠানের বাড়ন্ত গ্রোথ কমিয়ে দেয়।
১২. অপ্রয়োজনীয় গল্প:
শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানে এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়েই বসে পড়ে এলোমেলো গল্প নিয়ে। রাস্তার পাশে চায়ের টংয়ে বসে শুরু হয়ে যায় হাবিজাবি উপাখ্যান। 
১৩. গীবত বা পরনিন্দা:
শিক্ষক মিলনায়তন গুলো অধ্যয়ন বাদ দিয়ে বা শিক্ষার মানোন্নয়নের চিন্তা বাদ দিয়ে পরস্পরের মধ্যে গীবত ও পরনিন্দার মহোৎসব শুরু হয়।
১৪. আদেশ ও আনুগত্যের ভারসাম্যে অনৈক্য:
প্রতিষ্ঠান প্রধান, সিনিয়র ও জুনিয়র শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টি করে আদেশ ও আনুগত্যের ভারসাম্য নষ্ট করে। প্রতিষ্ঠান প্রধানের বৈধ নিয়মনীতি ও কর্মসূচিকে সুন্দর ও সঠিক ভাবে বাস্তবায়ন করতে অনীহা।
১৫.সভাপতি ও রাজনৈতিক মতাদর্শ:
এমপিও ভুক্ত অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান গুলো রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি হয়ে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি নির্বাচন বা মনোনয়ন করা হয়। যখন যে দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন তারা তাদের নিজস্ব চিন্তা চেতনা প্রতিষ্ঠিত করে যা একটি প্রতিষ্ঠানের মৌলিক অবস্থান ভঙ্গুর করে। সভাপতি পক্ষ ও বিপক্ষ গ্রুপিং তৈরি করে প্রতিষ্ঠানের উপর নগ্নভাবে শিক্ষার্থীদের অধিকার খর্ব করে।
১৬.প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগ:
প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যিনি সভাপতি হয় তিনি যোগ্যতা, আদর্শ ও নীতিনৈতিকতা বিবেচনা না করে নিজ গ্রুপের বা মতের হলে সকল অযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ প্রধান করা হয়।
১৫. বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী অপ্রতুলতা:
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় এমপিও ভুক্ত প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নিম্নমুখী। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে ৫ জন,৩ জন,০৮জন, ১০ জন শিক্ষার্থী।এই গুটিকয়েক শিক্ষার্থীর পিছনে শ্রম দিচ্ছে এনটিআরসি তে লিখিত,মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষাকগণ। এই অপ্রতুল শিক্ষার্থী ও শিক্ষার অনগ্রসর পরিস্থিতির কারণে বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী শিক্ষাকরা মুখ থুবড়ে পড়ছে।
করণীয়:
১. নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও রিফ্রেশার কোর্সে অংশগ্রহণ
২. শিক্ষকদের মূল্যায়ন, পুরস্কার ও প্রণোদনার ব্যবস্থা
৩. উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি, যেমন পাঠদান পর্যবেক্ষণ ও সহায়ক   অবকাঠামো
৪. ব্যক্তিগত পাঠাভ্যাস ও গবেষণা চর্চা
৫. আত্মসমালোচনা ও পেশাদারিত্ব বজায় রাখা
৬. শিক্ষাুনুরাগী ও শিক্ষাবিদ শ্রেণির হাতে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ন্যাস্ত করা
৭. বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থী বৃদ্ধি করার জন্য বাস্তবভিত্তিক কর্মপন্থা ঠিক  করা
৮. রাজনৈতিক আদর্শের চেয়ে ব্যক্তির মান,ব্যক্তিত্ব,যোগ্যতা ও শিক্ষা বিষয়ে দক্ষতা সম্পন্ন লোকদের কে অগ্রাধিকার দেয়া
৮. প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষকদের পাঠ উপযোগী মিলনায়তন, বিজ্ঞান ল্যাব,সমৃদ্ধ  লাইব্রেরীর পরিবেশ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা
৯. যেসকল প্রতিষ্ঠান এমপিও ভুক্ত প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরও শৃঙ্খলা, ফলাফল ও সার্বিক দিক দিয়ে উন্নত সে-সকল প্রতিষ্ঠান ভিজিট করিয়ে প্রেরণা সৃষ্টি করা
১০.আর্থিক স্বচ্ছলতা ও প্রনোদনা নিশ্চিত করে সঠিকভাবে জবাবদিহিতার আওতায় আনা
উপসংহার: মেধা ক্ষয় একটি প্রক্রিয়া, এটি তখনই হয় যখন শিক্ষক নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা বন্ধ করে দেন। যথাযথ মূল্যায়ন, প্রশিক্ষণ, পেশাদার মনোভাব ও আত্মউন্নয়নের চর্চা থাকলে একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক আজীবন মেধাবী হয়ে থাকতে পারেন।