তীব্র উত্তেজনার আবহে, অবশেষে মধ্যপ্রাচ্যের দুই চিরবৈরী প্রতিপক্ষ ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে বহু প্রতীক্ষিত সরাসরি সংঘাতের পর্দা উঠেছে। জুনের মাঝামাঝি রাতের আকাশ যখন নিস্তব্ধ, তখন হঠাৎই আকাশভরা আগুনের লেলিহান শিখায় আলোকিত হলো ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিব ও এর আশপাশের শহরগুলো। ইরান প্রায় শতাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ক্রুজ মিসাইল ও ড্রোন একযোগে ইসরায়েলের বিভিন্ন কৌশলগত স্থাপনায় নিক্ষেপ করে। এই আক্রমণ ইসরায়েলকে কেবল নিরাপত্তার দিক থেকে নয়, মনস্তাত্ত্বিক ও সামরিক বাস্তবতায়ও দারুণ চাপে ফেলে দেয়।
ইরান বহুদিন ধরেই প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিল, বিশেষ করে সিরিয়ায় আইআরজিসি’র কমান্ডারদের হত্যাকাণ্ডের পরে। কিন্তু এমন সমন্বিত, পরিকল্পিত এবং প্রযুক্তিনির্ভর হামলার মাত্রা অনেকের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ এবং ‘ডেভিডস স্লিং’ কিছুটা সাফল্যের সঙ্গে বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্র বাধা দিলেও, সবকিছু ঠেকানো সম্ভব হয়নি। বেশ কিছু মিসাইল সফলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল তেল আবিবের মিলিটারি হেডকোয়ার্টার ‘কির্যা’, যা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার হৃদপিণ্ড বলে বিবেচিত। এই আক্রমণে ভবনের মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে উচ্চ পর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা সরিয়ে নেওয়া হয়।
এছাড়া রামাত-গান, রিশন-লে-জিয়ন, এবং নেস-জিওনা শহরের ওপরেও ক্ষেপণাস্ত্রের টুকরো পড়েছে, যার ফলে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে প্রাণহানি ঘটে। অন্তত তিনজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে, আহতের সংখ্যা আশি ছাড়িয়ে গেছে, যাদের মধ্যে কিছু শিশু ও নারীও রয়েছে। হাসপাতালগুলোতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়, এবং বহু মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে হয়। ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বেশ কয়েকটি এলাকায়। পানীয় জল সরবরাহ ও মোবাইল টাওয়ার যোগাযোগেও বিঘ্ন ঘটে।
এই হামলা শুধু অবকাঠামোগত ক্ষতি নয়, বরং ইসরায়েলের কৌশলগত আত্মবিশ্বাসে বড় রকমের ফাটল ধরিয়েছে। বিশ্বজুড়ে যার ইমেজ ছিল ‘অজেয় প্রতিরক্ষা বলয়, সেই ধারণা এবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়েছে। একসঙ্গে এত বিস্তৃত অঞ্চলে হামলা প্রতিহত করা যে কতটা দুরূহ, তা বুঝিয়ে দিয়েছে এই আক্রমণ। আর মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে, যে ইসরায়েল এতদিন আক্রমণ করে পার পেয়ে যেত, এবার তার ভৌগোলিক গভীরে এসে আঘাত হানা হয়েছে।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও এই হামলা চরম চাপ সৃষ্টি করেছে। একদিকে মিলিটারি কমান্ড সেন্টারের ধ্বংস ও পুনঃগঠনের খরচ, অন্যদিকে বেসামরিক এলাকায় যেসব বাসস্থান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা দ্রুত পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এছাড়া, বিমা কোম্পানিগুলোর উপরে ব্যাপক চাপ তৈরি হয়েছে ক্ষতিপূরণ ইস্যুতে। অধিকন্তু, আতঙ্কে স্টক মার্কেটেও ধস নামে—বিশেষত প্রতিরক্ষা ও পর্যটন খাতে।
এই হামলার মাধ্যমে ইরান শুধু প্রতিশোধ নেয়নি, বরং একটি বার্তা দিয়েছে—তাদের প্রযুক্তি, প্রস্তুতি ও রাজনৈতিক সাহস, সবই এখন উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এবং তারা আর পরোক্ষ নয়, সরাসরি সংঘাতে অবতীর্ণ হতে পিছপা নয়। এই মনোভাব ইসরায়েল এবং তার মিত্রদের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও ইসরায়েল পাল্টা জবাবের হুমকি দিয়েছে, তবুও এমন এক আঘাত যা তাদের গভীরতম কেন্দ্র স্পর্শ করেছে—তার প্রতিকার এত সহজে সম্ভব নয়।
এই ক্ষয়ক্ষতি কেবল স্থাপনার নয়, বরং গর্ব, মনোবল ও কৌশলগত নিয়ন্ত্রণেরও। আর এটাই ইরানের হামলার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তেল আবিবের আকাশ থেকে ধোঁয়া সরতে সময় লাগবে—কিন্তু তার প্রভাব যে দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা নিশ্চিত।