আট বছরের শিশুর ওপর নৃশংসতা: মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে, বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (পিআইসিইউ) ২২৩ নম্বর ওয়ার্ডে শুয়ে আছে আট বছরের একটি শিশু। নিথর দেহ, অচেতন চোখ। ডাকলে সাড়া দিচ্ছে না। শরীরে অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন। তিন দিন পেরিয়ে গেলেও জ্ঞান ফেরেনি তার। রাতের আঁধারে নিপীড়িত এই শিশুটি এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।

শিশুটির মা ওর পাশেই বসে আছেন। ডান হাত মেয়ের মাথায়, বাঁ হাত দিয়ে চোখের পানি মুছছেন। ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের কান্না আর থামাতে পারছেন না। মাঝে মাঝেই মূর্ছা যাচ্ছেন। বারবার শুধু বলছেন, "আমার মেয়ে কথা বলছে না। ডাকলেও সাড়া দিচ্ছে না। মেয়ের কী হবে? ওদের ফাঁসি চাই!"

শিশুটির স্বজনরা জানায়, মাগুরা সদরের নিজনান্দুয়ালী গ্রামে তার বড় বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে এই নৃশংসতার শিকার হয় সে। মূল অভিযুক্ত তার দুলাভাইয়ের বাবা হিটু শেখ (৪৭)। সেই রাতে শিশুটির গলায় কিছু পেঁচিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে।

ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত

গত বুধবার রাতে শিশুটির বড় বোনের শ্বশুরবাড়িতে এই ঘটনা ঘটে। পরিবার জানায়, শিশুটির বড় বোন প্রায়ই ভয় পেতো, তাই সে ছোট বোনকে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। মা রাজি হন। কিছুদিন থাকার পর শিশুটি বাড়ি ফিরে আসবে—এমনটাই পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বুধবার রাতে ঘটে ভয়ংকর সেই ঘটনা।

শিশুটির মামাতো ভাই বলেন, "বড় বোন ধর্ষণের ঘটনা দেখে ফেলায় তাকে ঘরে আটকে রেখে বেধড়ক মারধর করে তার স্বামী সজিব শেখ (১৮) ও শ্বশুর হিটু শেখ। হুমকি দেওয়া হয়, কাউকে জানালে তাকে মেরে ফেলা হবে।"

রক্তাক্ত শিশুটিকে তখনও কোথাও নেওয়া হয়নি। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করছিল সে। পরদিন সকালে অভিযুক্তের মা তাকে মাগুরা সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু শিশুটির শারীরিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকলে সেখান থেকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপরও উন্নতি না হলে তাকে ঢামেকে স্থানান্তর করা হয়।

তদন্ত ও গ্রেপ্তার

ঘটনার পর পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে শিশুটির দুলাভাই সজিব শেখ ও তার বাবা হিটু শেখকে আটক করেছে। তবে এখনো মামলা হয়নি, কারণ শিশুটির পরিবার লিখিত অভিযোগ দিতে পারেনি।

মাগুরা সদর থানার ওসি আইয়ুব আলী জানান, "সন্দেহজনকভাবে বাবা-ছেলেকে আটক করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।"

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিরাজুল ইসলাম বলেন, "সজিব শেখের কথায় অসংলগ্নতা পাওয়া গেছে। তদন্ত চলছে, অপরাধীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।"

বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ

শুক্রবার জুমার নামাজের পর মাগুরা শহরে ফুঁসে ওঠে জনতা। কয়েকশ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, বিক্ষোভ করে। সদর থানার সামনে গিয়ে তারা অভিযুক্তদের দ্রুত শাস্তির দাবি জানায়। পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি গুজব পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তোলে। অনেকেই দাবি করেন, শিশুটি মারা গেছে। ক্ষুব্ধ জনতা থানার ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ ও সেনাবাহিনী তাদের ছত্রভঙ্গ করে।

একটা সমাজ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?

শিশুটির বাবা একজন ভ্যানচালক। অর্থের অভাবে তার বড় মেয়ের ওপরও এর আগে পাশবিক নির্যাতনের চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু পরিবার চুপ করে ছিল। আজ যখন ছোট মেয়েটির ওপর এই ভয়াবহ অত্যাচার হলো, তখন আর চুপ করে থাকার কোনো উপায় নেই।

মা হাসপাতালের ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে বিলাপ করছেন, "আমার মেয়ে কি বেঁচে থাকবে? আমার কিছুই নেই, আমি ন্যায়বিচার পাবো তো?"

কিন্তু এই মায়ের প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? একটা শিশু যখন পাশবিকতার শিকার হয়, তখন দায় শুধুই ধর্ষকের? নাকি এই সমাজেরও?