প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসে বিশ্ববাজারে নিজের জায়গা তৈরি করা কোনো সহজ বিষয় নয়। কিন্তু মো. আব্দুল মালেক — যাকে ফ্রিল্যান্সিং জগতে এবং আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টরা সবাই তানভীর এ. মালেক নামে চেনেন—তিনি প্রমাণ করেছেন, ইচ্ছাশক্তি, অধ্যবসায় আর আন্তরিকতা থাকলে অসম্ভব কিছুই নয়।
সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার চরবেত কান্দী গ্রামের এই তরুণ এখন কাজ করছেন বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা প্রতিষ্ঠানের সাথে, ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে।
শুরুর গল্প: সীমাবদ্ধতার মাঝে জেদ আর স্বপ্ন
তানভীর এ. মালেকের গল্প শুরু হয়েছিল কঠিন বাস্তবতা থেকে। ২০১৯ সালে যখন তিনি ফ্রিল্যান্সিং শুরু করতে চাইলেন, তখন নিজের কোনো কম্পিউটার ছিল না। কাজ করতেন একটি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে। দিনভর অফিসে কাজ, আর রাতে নিজের ফোনে ইউটিউব ভিডিও দেখে শেখার চেষ্টা—এভাবেই কেটেছে প্রায় এক বছর।
বহু চেষ্টা, ধৈর্য ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও তানভীর থেমে যাননি। তার এই অধ্যবসায় দেখে একসময় তার সহধর্মিণী তার সবচেয়ে প্রিয় কানের দুল বিক্রি করে ১৫ হাজার টাকা দেন, যাতে তিনি একটি সেকেন্ড হ্যান্ড ল্যাপটপ কিনতে পারেন।
এই ল্যাপটপ ছিল শুধু প্রযুক্তির হাতিয়ার নয়—এটি ছিল ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং নতুন জীবনের সম্ভাবনার প্রতীক। সেই ল্যাপটপেই শুরু হয় নতুন অধ্যায়। প্রায় সাত মাসের মধ্যে ফাইভারে পান প্রথম ১০ ডলারের অর্ডার। এরপর থেকে পেছনে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে ফাইভার ও আপওয়ার্ক মারকেটপ্লেসে রয়েছেন দারুণ ছন্দে।
আজকের অবস্থান: দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিকতায়
বর্তমানে তানভীর এ. মালেক একজন সফল আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার। কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি সহ বিভিন্ন দেশের ক্লায়েন্টদের সঙ্গে।
তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানে Communication Manager হিসেবে পার্মানেন্ট কাজ করছেন এবং থাইল্যান্ডের একটি প্রতিষ্ঠানে Virtual Assistant হিসেবে যুক্ত।
দক্ষতা ও কাজের ধরন:
তানভীর মালেকের কাজের দক্ষতা ও পরিধি। তিনি মূলত নিম্নোক্ত সেবাগুলো দিয়ে থাকেন:
লিড জেনারেশন
ডিজিটাল মার্কেটিং
ওয়েব রিসার্চ
ভার্চুয়াল এসিস্ট্যান্ট
আয় ও আত্মবিশ্বাস:
তানভীর এ. মালেকের ফ্রিল্যান্সিং যাত্রা আজ তাকে শুধু দক্ষতাই নয়, দিয়েছে আর্থিক স্বচ্ছলতা ও মানসিক আত্মবিশ্বাস।
দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকলেও, ফ্রিল্যান্সিং তার জীবনে এনেছে এক নতুন দিগন্ত।
বর্তমানে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছেন, এবং প্রতিমাসে একজন সম্মানজনক পেশাজীবীর মতোই আয় করছেন, যা তাকে পরিবার পরিচালনার পাশাপাশি অন্যদের সহযোগিতার সামর্থ্যও দিয়েছে।
তার নেতৃত্বে পরিচালিত টিমের সদস্যরা নিজ নিজ কাজের মাধ্যমে নিজের এবং পরিবারের চাহিদা পূরণ করছেন। এমনকি কেউ কেউ পড়াশোনা পরিচালনা করছেন ফ্রিল্যান্সিং আয়ের মাধ্যমে।
চাকরি থেকে ফ্রিল্যান্সিং: এক সাহসী সিদ্ধান্ত:
প্রায় ৯ বছর তিনি একটি সুনামধন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। পদবি ও বেতন উভয়ই ছিল ভালো অবস্থানে।
কিন্তু যখন বুঝলেন, ফ্রিল্যান্সিং কেবল বিকল্প নয় বরং একটি পূর্ণাঙ্গ, স্বাধীন ও সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার — তখন তিনি চাকরি ছেড়ে দেন।
কারণ, এখানে সময়ের স্বাধীনতা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে বৈশ্বিক পর্যায়ে নিজেকে তুলে ধরার সুযোগ।
শিক্ষা বিস্তারে অঙ্গীকার:
সাফল্যের পথ একা হেঁটে থেমে থাকেননি তানভীর। নিজ উদ্যোগে তিনি এখন পর্যন্ত ২০০-এর বেশি মানুষকে সম্পূর্ণ ফ্রিতে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
এই উদ্যোগের লক্ষ্য শুধু দক্ষ ফ্রিল্যান্সার তৈরি নয়, বরং প্রত্যন্ত অঞ্চলের তরুণদের জন্য প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করা।
বর্তমানে তার একটি দল রয়েছে, যেখানে ১২ জন সদস্য অনলাইনে যুক্ত হয়ে নিজ বাড়ি থেকে কাজ করছে এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করছে।
মার্কেটপ্লেসের বাস্তবতা ও বাইরের দৃষ্টি:
তানভীর বলেন —
“বেশিরভাগ নতুন ফ্রিল্যান্সারই মার্কেটপ্লেসেই সব সম্ভাবনা খুঁজে ফেরে। অথচ বাস্তবতা হলো, ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসগুলোতে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কাজ হয়, বাকি বিশাল অংশের কাজ হয় সরাসরি ক্লায়েন্টদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে।”
এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তিনি নতুনদের উৎসাহ দেন মার্কেটপ্লেসের বাইরে ক্লায়েন্ট তৈরির কৌশল রপ্ত করতে।
ভবিষ্যতের স্বপ্ন:
তানভীর বিশ্বাস করেন, ফ্রিল্যান্সিং শুধু ব্যক্তি নয়, সমগ্র সমাজকে বদলে দেওয়ার একটি উপায়। ভবিষ্যতে তিনি চান সিরাজগঞ্জের প্রতিটি ঘরে প্রযুক্তির ছোঁয়া পৌঁছাক, যাতে এখানকার তরুণরাও বৈশ্বিক পর্যায়ে নিজের জায়গা করে নিতে পারে।
এই লক্ষ্যেই তিনি ভবিষ্যতে নিজ এলাকায় গঠনমূলক প্রশিক্ষণ প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছেন।
তিনি স্বপ্ন দেখেন, সিরাজগঞ্জ একদিন হবে একটি “ ফ্রিল্যান্সিং জেলা” — যেখানে শত শত তরুণ-তরুণী আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করে নিজের পরিবার ও দেশকে এগিয়ে নেবে।
এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তিনি সিরাজগঞ্জের অন্যান্য উদ্যমী ফ্রিল্যান্সারদের সাথে নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে চান — যেন জেলা জুড়ে গড়ে ওঠে দক্ষতা ভিত্তিক এক নতুন প্রজন্ম।
দৃষ্টিভঙ্গি ও পরামর্শ:
তানভীরের মতে, সফলতা আসে তখনই যখন শেখা, ধৈর্য, এবং ক্লায়েন্টকে বোঝার ক্ষমতা থাকে। যারা শুধু মার্কেটপ্লেসের উপর নির্ভর করে — তারা অনেক সময় পিছিয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, “ফ্রিল্যান্সিং পার্ট-টাইম কাজ নয়। এটা পরিপূর্ণ মনোযোগ ও পেশাদারিত্বের দাবিদার।”
তানভীর এ. মালেকের গল্প কেবল একজন তরুণের নয়, এটি একটি অঞ্চলের আশাবাদের প্রতীক। চরবেত কান্দীর মতো প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও বিশ্ববাজারে সফলতা অর্জন সম্ভব — যদি থাকে জেদ, ভালোবাসা আর ত্যাগের শক্তি।