বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে উচ্চাভিলাষী অনেক প্রকল্পের সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে, সেখানে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড রিসার্চ (নিটার) এক ব্যতিক্রমী সফলতার গল্প তৈরি করেছে। দেশের প্রথম পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে নিটার বাংলাদেশের বস্ত্র খাতে বৈপ্লবিক অবদান রেখে চলেছে।

চাকরির সুযোগ: অন-সাইট রিক্রুটমেন্ট ও চাকরি মেলা
চাকরির বাজারে নিটারের শক্তিশালী অবস্থান লক্ষণীয়। প্রতি বছর দেশের স্বনামধন্য জায়ান্ট কোম্পানিগুলো অন-ক্যাম্পাস রিক্রুটমেন্টের মাধ্যমে সদ্য গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা ব্যাচ থেকে তাদের কর্মী নির্বাচন করে। এছাড়াও, নিটার নিয়মিত চাকরি মেলার আয়োজন করে, যেখানে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি ক্যাম্পাস থেকে গ্র্যাজুয়েটদের নিয়োগ দেয়।

গবেষণা ও উদ্ভাবনে নিটারের অবদান: শিক্ষার্থীদের গবেষণা সম্পৃক্ততা বাড়াতে নিটারে রয়েছে সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন (CRIR)। নিটারের শিক্ষার্থীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণায় তাদের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। ২০১৫ সালে এক শিক্ষার্থী আনারসের পাতা থেকে ফাইবার উদ্ভাবন করে 'টেক্সটাইল ট্যালেন্ট হান্ট' প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালের নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জের ঢাকা রিজিওনাল বিভাগে নিটার চ্যাম্পিয়ন হয় এবং ২০১৯ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি, দিল্লি)-তে অনুষ্ঠিত ফাংশনাল টেক্সটাইল এন্ড ক্লোদিং কনফারেন্স (এফটিসি) প্রতিযোগিতায় বিশ্বের নব্বইটি দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে, যা নিটারের গবেষণা সক্ষমতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ও শিক্ষার মান: নিটারে ব্যাচেলর পর্যায়ের পাঁচটি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে প্রায় ১৮৭৩ জন শিক্ষার্থী এবং ৮৬ জন শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনুপাত ১:২০, যা আন্তর্জাতিক শিক্ষার মানদণ্ডের মধ্যে পড়ে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ৪০ থেকে ৬০ জন শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র একজন শিক্ষক থাকেন, সেখানে নিটারের এই আদর্শ অনুপাত মানসম্মত শিক্ষাদানের নিশ্চয়তা প্রদান করে।

চাকরির বাজারে প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হলো শিল্প কারখানার সাথে তাদের গভীর সম্পর্ক। এই দিক থেকে নিটার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা প্রাকৃতিকভাবেই বিটিএমএ সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলোর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ পায়। এছাড়াও, প্রযুক্তি ইউনিটের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বৃহত্তম অ্যালামনাই কমিউনিটি থাকার কারণেও শিক্ষার্থীরা সহজেই বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে ভিজিট বা ইন্টার্নশিপের সুযোগ পায়। সম্ভবত নিটারই বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে শিক্ষার্থীরা কোনো ব্যক্তিগত পূর্বপরিচয় ছাড়াই কেবল প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ে ও নিজের যোগ্যতায় সরাসরি শিল্প-কারখানার মালিকদের সাথে নিজেদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারে এবং তাদের থেকে সমাধানও পেয়ে যায়। এসব কারণে নিটার দেশের 'হাইয়েস্ট জব-প্লেসমেন্ট রেট' সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম।

গ্র্যাজুয়েটদের সাফল্যের হার: নিটারের গ্র্যাজুয়েট হওয়া ব্যাচগুলোর সাক্সেস রেট প্রায় শতভাগ। সবাই শুধু চাকরির জগতেই বিচরণ করছে না; অনেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন, অনেকে সফল উদ্যোক্তা হচ্ছেন, আবার অনেকে দেশেই উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। যারা টেক্সটাইল থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন, তাদের বেশিরভাগই মাসকো, স্কয়ার, ফকির গ্রুপ, ডিভাইন গ্রুপ, ডিবিএল গ্রুপের মতো শত শত ইন্ডাস্ট্রিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। আইপিই থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা শিক্ষার্থীরা এপেক্স, প্রাণ, রানার, YKK এর মতো বড় বড় কোম্পানিতে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছেন। বিটিএমএ-এর অধীনে প্রায় ২০০০টিরও বেশি ইন্ডাস্ট্রি চলমান থাকায় প্রতি বছরই নিটার থেকে গ্র্যাজুয়েট নিয়ে যাওয়ার পথ সুগম থাকে, যার বাইরেও নিটারিয়ানরা নিজেদের যোগ্যতায় বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করছেন।

আধুনিক গবেষণা নির্ভর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নিটার: বস্ত্রশিল্পকে রপ্তানি বাজারে টিকে থাকতে হলে গবেষণা ভিত্তিক উন্নয়ন কৌশল এবং গুণগত মানের পোশাক সরবরাহ অপরিহার্য। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এবং বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পকে তুলে ধরতে একটি আধুনিক গবেষণা নির্ভর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সেদিক বিবেচনায় জাতীয় বস্ত্র প্রকৌশল ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (নিটার) সবগুলো সূচকই পূর্ণ করে। উন্নত শিক্ষাপদ্ধতি, উপকরণ এর মাধ্যমে পাঠদান এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার ফলে নিটার ইতোমধ্যেই একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেছে। এছাড়াও, প্রতিষ্ঠানটি একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাবের মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প খাতের প্রকৃত চিত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করা নিটারের শিক্ষার্থীদের জন্য তুলনামূলক সহজ। একজন নিটারিয়ান হিসেবে এটি নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়।

নিটার বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের ভবিষ্যৎ গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।