আমরা জানি অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান,চিকিৎসার ন্যায় শিক্ষাও মানুষের মৌলিক চাহিদা ।   

শিক্ষা অর্জনের জন্য পবিত্র  ধর্মগ্রন্থ সমূহেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে যে জ্ঞান অন্বেষণ প্রতিটি নর-নারী জন্য ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য। 

 মানুষের মৌলিক চাহিদা,অধিকার, মর্যাদা ও সমাজে ন্যায় বিচার  প্রতিষ্ঠা করতে হলে দেশের নাগরিকদের নিজ দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে উৎপাদনক্ষম করে গড়ে তোলা জরুরী। এ ধরনের  সুনাগরিক তৈরীর প্রধানতম উপাদান  হলো শিক্ষা।  শিক্ষা  মানুষের একটি জন্মগত অধিকার যা আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার।

সেই দিক বিবেচনায় বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকার দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। তারই অংশ হিসেবে   গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিশেষজ্ঞদের নিয়ে  পরামর্শক  কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরামর্শক কমিটি  প্রাথমিক ও  উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সংক্রান্ত আটটি বিষয় নিয়ে শতাধিক প্রধান ও আনুষঙ্গিক সুপারিশ প্রদান করেছেন। বিভিন্ন  অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় এবং প্রত্যন্ত চঞ্চলসহ দেশের ১১ টি জেলা  এবং ১২ টি উপজেলা সরে জমিনে পরিদর্শন করে কমিটি সুপারিশ মালা তৈরি করেছেন। কার্যক্রম গুলোকে অতিদ্রুত,  স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদে করনীয় হিসাবে ভাগ করা হয়েছে। সুপারিশ তৈরিতে দুটি বিষয় বিশেষ বিবেচনায় রাখা হয়েছে:

(১) নানা উদ্যোগ সত্বেও শিখন-মানের ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা বিরাজ করছে তা দূর করা।

(২)শিশুর শিখন,কল্যাণ ও নিরাপত্তাকে সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে স্থাপন করা।

যে প্রধান আটটি বিষয় চিহ্নিত করে সুপারিশ প্রণীত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে:

(১) শিক্ষক-শিখন ও শিক্ষার্থী মূল্যায়ন।

(২) শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী 

(৩)অভিগম্যতা, অন্তর্ভুক্তি ও বৈষম্য নিরসন।

(৪) প্রাক- প্রাথমিক শিক্ষা ও শিশুর বিকাশ।

(৫) উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাওবিদ্যালয়-বহির্ভূতশিশু।

(৬) শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা। 

(৭)ক্ষেত্রনির্বিশেষে ক্রস-কাটিং বিষয়। 

(৮)সংস্কারবাস্তবায়ন,অর্থায়ন ও পরবর্তী

     পদক্ষেপ। 

এ প্রবন্ধে শুধু প্রাথমিক শিক্ষায় স্থবিরতা নিয়ে কিছু উপস্থাপনার প্রয়াস। সর্বশেষ তথ্যঅনুযায়ী দেশজুড়ে ৬৫ হাজার ৯৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিশুদের বিনামূল্যে পাঠদানে নিয়োজিত। এতে ৩,লাখ ৪৮ হাজার ৫৮৪ জন শিক্ষক, ২ কোটি ৯ লাখ ১৯ হাজার  ২০১ জন শিক্ষার্থীকে  পাঠদান করছেন। কিন্তু এর বাইরে শিক্ষার্থী,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে কাওমি  মাদ্রাসার সঠিক পরিসংখ্যান জানা না থাকলেও তার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।

দেশের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ৮লাখ ৩২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে। আবার ২৩ সালের তুলনায় কি পরিমান শিক্ষার্থী কমেছে তার প্রতিবেদন এখনো তৈরি হয়নি তবে এ সময় কিন্ডারগার্টে  প্রায় ২ লাখ ৫৬ হাজার,  মাদ্রাসায় ৩৬ হাজার  শিক্ষার্থী বেড়েছে বলে জানা যায়  বিদায়ী বছরের মাঝামাঝি তৈরি  প্রতিবেদনে। 

শিক্ষাদানের মূল কেন্দ্র হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর তা র পাশঘিরে আছে শিক্ষক,  শিক্ষার্থী অভিভাবক ও অন্যান্য অংশীজন। প্রত্যেকের অবস্থান থেকে তার  সমস্যা গুল চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজে নিতে পারলেই কেবল  শিক্ষাক্ষেত্রে স্থবিরতা দূর করা সম্ভব। 


পরামর্শ কমিটি পর্যালোচনা ও সুপারিশ তৈরিতে প্রথম যে বিষয়টি বিবেচনায় আনার কথা বলেছেন তা হলো নানা উদ্যোগ  সত্ত্বেও শিখন মানের ক্ষেত্রে স্থবিরতা দূর করা। বর্তমানে  প্রাথমিক শিক্ষায় স্তবিরতার অন্যতম কারণ হলো শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি। আবার অনুপস্থিতির অন্যতম কারণ মাদ্রাসায় ভর্তি। মাদ্রাসা ভর্তির জন্য বছরের শ্রুতিমধুর বিজ্ঞাপন  মাইকে আহ্বান ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিষয়ে এমন ধারণা দেওয়া হয় যেন  মাদ্রাসায় সন্তানদের ভর্তি করলেই দুনিয়া ও আখেরাতের হিসাব সহজ হয়ে যাবে। তাছাড়া করোনা কালীন সময়ে  সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও মাদ্রাসা  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল না। মাদ্রাসার কোন শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হয় নাই। এমন ধারণা  অভিভাবকগণকে মনে করেন মাদ্রাসা শিক্ষায় নিরাপদ ইহকাল এবং পরকালেও কল্যাণ বয়ে আনবে। ধর্মীয় মহাসমাবেশেও  আলেম ওলামরা  প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানদের ভর্তির ব্যপারে নিরুৎসাহিত  করা হয়ে থাকে।

এ প্রশ্নে বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন শিক্ষকদেরও দায়িত্ব অভিভাবকদের সাথে এবিষয়ে কথাবলে তাদেরকে বিদ্যালয়ে আসতে উদ্ভুদ্ধ করা। এটাতো একে অপরের মুখোমুখি দারকরানো ছাড়া আর কিছুই না। এর জন্য দরকার সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি। 


সরকারি বিধান অনুযায়ী দুই কিলোমিটার পরপর প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের নিয়ম থাকলেও এরকম কোন বিধি-বিধান মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে নেই। একই বিল্ডিং এ একাধিক মাদ্রাসা অহরহ দেখা যায় মফস্বল শহরসহ গ্রাম গঞ্জেও। শিক্ষা স্থবিরতা দূর করতে প্রথমেই মাদ্রাসা স্থাপনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নিয়ম কানুন তৈরি করা উচিত বলে মনে করি সেই সাথে পাঠ্যবিষয় নির্বাচনেও সমন্বয় সাধন করতে হবে।


প্রাথমিকের অনেক শিক্ষক তাদের সন্তানকে কিন্ডারগার্টেন স্কুল, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলসহ বিভিন্ন প্রাইভেট স্কুলে পড়াচ্ছেন যা আদৌ কাম্যনয়।এ বিষয়ে অভিযোগ করে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানকে কেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াবেন বলে প্রশ্ন তোলেন।শুধু তাই নয় অনেক প্রাথমিক শিক্ষকও সরাসরি এসব প্রতিষ্ঠানে জড়িত থাকেন। তাছাড়া প্রাথমিকের সিলেবাস ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসে গুনগত পার্থক্য রয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষকের অভিমত হলো তারা শিক্ষা দানের মূলভিত্তি হলেও বেতন কাঠামো এতটাই দু্র্বল যে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পারিবারিক ব্যায় মিটিয়ে নিজের ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়ে শ্রেণিপাঠদানে  যত্নশীল  হওয়া শুধু কষ্টসাধ্য নয় দূরুহও বটে।

গ্রামের সাধারণ  অভিভাবক শিক্ষার ব্যপারে অনেকটাই সচেতন। তারা এখন ভাবতে শিখেছে শিক্ষার প্রয়োজনে সন্তানের জন্য ব্যায় করা উত্তম বিনিয়োগ। বিনিয়োগ ছাড়া যেমন লাভ হয়না তেমনি ভাবে লেখা পড়ার জন্য ব্যায় না করলে লেখা পড়া হবেনা। তারা মনে করে যে বিদ্যালয়ে মাসিক বেতন, পরীক্ষা ও পরীক্ষার  ফি  যতবেশি সে বিদ্যালয় ততোধিক ভালো। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখা পড়া করবে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তানেরা। যে কারনে  সচ্ছল পরিবার সন্তানরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাতে অনিহা প্রকাশ করে।

ফেসবুক সর্বস্ব  বহুধাবিভক্ত প্রাথমিক শিক্ষক সংঘটন গুলো অভিন্ন ও ভিন্ন ভিন্ন দাবি নিয়ে নিজস্ব আঙ্গিনা থেকে  আন্দোলনের মাঠে আছে।সর্বশেষ সহকারি শিক্ষকদের দশম গ্রেডের ন্যায্য দাবিটি নিয়ে  পক্ষে বিপক্ষে কাদাঁ ছুড়াছুড়ি লেগেই আছে। শিক্ষক নেতারা কোন একটা দাবী নিয়ে ঐক্যে পৌঁছাতে ব্যার্থ। তৈরি হচ্ছে একে অপরের প্রতি আস্থার সংকট। সেই সাথে হচ্ছে শ্রেণিপাঠদান ব্যাহত। দশম গ্রেডকে  শুধুই বেতন  স্কেলের ফ্রেমে  দেখলে  ঠিক   হবেনা। এ দাবি  শিক্ষকদের মর্যাদার। থার্ড ক্লাস থেকে সেকেন্ড ক্লাস   পরবর্তীতে ফাস্ট ক্লাস । সহকারী শিক্ষকদের ভাবনা  এ  দাবি  তাদের  অপরদিকে   প্রধান শিক্ষকদের  ভাবনা  এ দাবি  সহকারীদের। আসলে  এ দাবি  শিক্ষক সমাজের মর্যদার দাবি প্রাথমিক শিক্ষায় সকল অংশীজনের। এ হীন পরিস্থিতি  প্রধান  ও সহকারীদের হীন মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। সময় এসেছে ঐক্যের,অন্যতায় আরো খারাপ অবস্থা প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের সামনে অবস্থান করছে। 

 

বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় স্তবিরতার আরও  একটি কারন মামলাজট। সরকারের এ বিভাগটি সবচেয়ে বেশি   মামলা জটে ভারাক্রান্ত। তার  বেশিরভাগ মামলাই শিক্ষকদের অধিকার, মর্যাদা ও আর্থিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। যে কারনে মাঠপর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষা অনেকটাই স্থবির হয়ে আছে। বর্তমান সরকারের  প্রতি পরামর্শ থাকবে শিক্ষকদের অধিকার, মর্যাদা ও আর্থিক বিষয়গুলো আলোচনার মাধ্যমে সম্মানজনক সমাধান করে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগকে মামলা জট মুক্ত করে শিক্ষকদের আস্থার সংকট কাটিয়ে শিক্ষাদানের কাজে মনোনিবেশের আহ্বান জানানো।