“আসসালামু আলাইকুম, ওয়েলকাল বাংলাদেশ। আমি ফরিদা পারভিন সাথী আপনাদের মাঝে এসেছি ‘সাথী চা পাতা’ নিয়ে। সাথী চা পাতা দিচ্ছে গাঢ় লিকার, আহা কি মন মাতানো স্বাদ, এক কাপ চা খেলেই আপনার ভাঙা মন চাঙ্গা করে তুলবে। হই হই কাণ্ড-রই রই ব্যাপার, বাজারে এবার এলো সাথী চা।এভাবেই একটি সাউন্ডবক্স বাজিয়ে হাটে-বাজারে, পথে-প্রান্তরে সাইকেলে করে চা পাতা বিক্রি করেন ফরিদা পারভিন সাথী (৩২)।
প্রতিদিন প্রায় ৫০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে শহর ও গ্রামের হাট-বাজারের দোকানে চা পাতা বিক্রি করেন তিনি। সারাদিন যা বিক্রি হয় তা দিয়েই চলে তার দুই সদস্যের পরিবারের সংসার। শুধু চা পাতাই বিক্রি করেন না। রাতে স্বামীকে সহযোগিতা করার জন্য চায়ের দোকানেও সময় দেন কঠোর পরিশ্রমী এই নারী। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁও জেলা শহরের কোট চত্বরে  মধ্যবয়সী এক নারীকে দেখা যায়, সাইকেলের দুই পাশে চা পাতার ব্যাগ ও সাউন্ডবক্স বাজিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চা পাতা বিক্রি করছেন। তিনি  বলেন, চা পাতা লাগবে, মাত্র ১৩০ টাকা। দেখে মনে হলো তিনি খুবই ক্লান্ত, তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি জীবন যুদ্ধের কথা তুলে ধরেন। ফরিদা পারভিন সাথীর জন্ম পঞ্চগড়ের তেতুলিয়া উপজেলার শালবাহান মাঝিপাড়া গ্রামে। ১০ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। অভাবের সংসারে স্কুলের বারান্দায় বেশিদিন পা রাখতে পারেননি। কর্মের সন্ধানে জন্মভিটা ত্যাগ করে চলে যান ঢাকায়। এরপর শুরু হয় নতুন জীবনের সূচনা। কাজের ফাঁকে খুঁজে নেন জীবন সঙ্গী আব্দুল লতিফকে (৪০)। দুই পরিবারের সম্মতিতে ২০১৪ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আব্দুল লতিফের বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে। আব্দুল লতিফ পারিবারিকভাবে খুবই অসচ্ছল। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। রঙিন সংসারে নেমে আসে দুঃখের অন্ধকার। কাজের সন্ধানে ২০১৬ সালে চলে আসেন ঠাকুরগাঁও জেলা শহরে। স্বামী আব্দুল লতিফ মাসে ৫ হাজার টাকা বেতনে একটি দোকানে কাজ নেন। তা দিয়ে এক বেলা খেলে আরেক বেলার চিন্তা। তাই সাথীও কাজের খোঁজে দোকানে দোকানে ঘুরতে থাকেন। একপর্যায়ে শহরের গোধূলি বাজারে এক টেইলার্সের দোকানে ঝাড়ু-মোছার কাজ জোটে। সারা মাস কাজ করে দোকান মালিক ঠিকমতো মজুরিটাও দেন না। বরং উলটো সাথীর কাছেই কাজ শেখা বাবদ টাকা চেয়ে বসে। উপায়ন্তর  না পেয়ে লন্ড্রির দোকানে কাজ নেন। সেখানেও একই ঘটনা। মাস শেষে পারিশ্রমিক নিয়ে ঝামেলা। এরপর চলে যান নিজ জন্মভিটা তেতুলিয়ায়। সিদ্ধান্ত নেন চা কারখানা থেকে চা পাতা কিনে খোলা বাজারে কম দামে বিক্রি করবেন। কিন্তু চা কারখানায় লাখ টাকা ছাড়া চা বিক্রি করে না। ২০০ টাকার চা পাতা নেবে শুনে কারখানার লোকজন পাগল বলে তাড়িয়ে দেন। তারপরেও শত অপমান সহ্য করে চা কারখানায় যান। ম্যানেজারকে অনুরোধ করে ২০০ টাকার চা পাতা নেন। এরপর সেই চা পাতা বাসায় এনে প্যাকেটজাত করে খোলা বাজারে বিক্রির জন্য গেলে কেউ তাতে সায় দেননি। এরকম করে মাস পার হয়ে যায় কিন্তু কেউ শোনে না সাথীর কথা। প্রথম এক বছর পায়ে হেঁটে বাজারে বাজারে চা পাতা বিক্রি করেন। তাকে দেখে অনেকেই কটু কথা বলতেন। তাতে তিনি কান দেননি। এরপর বিক্রি শুরু হয় তার চা পাতা।  দিনে দিনে চাহিদা বাড়তে থাকে। ঘুরে যায় তার ভাগ্যের চাকা। লাভের টাকায় কেনেন একটি সাইকেল। এরপর সাইকেলে করে চা পাতা দোকানে দোকানে বিক্রি করেন। এভাবেই চলে তার টিকে থাকার সংগ্রাম। ধীরে ধীরে সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আসতে থাকে। শহরের হাজীপাড়া এলাকায় একটি দোকানঘর ভাড়া নেন সাথী। সেখানে তার স্বামী চা-পান বিক্রি করেন আর সাথী সারাদিন বাজারে বাজারে চা পাতা বিক্রি করেন। তাদের সংসারে কোনো সন্তান নেই। অভাবের সংসারে সন্তানকে কি খাওয়াবে সেই চিন্তা থেকেই  সন্তান নেননি এই দম্পতি। বর্তমানে ফরিদা পারভিন সাথী প্রতি মাসে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার চা পাতা বিক্রি করেন। আর প্রতি মাসে লাভ হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। সাথী  বলেন, ২০১৬ সালে স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে শহরে আসি। একটি টিন শেডের বাসা ভাড়া নিই। স্বামী দোকানে কাজ করে মাসে যে টাকা পেতেন সেটা দিয়ে চলা খুবই কষ্টকর ছিল। এক সময় না খেয়েই ছিলাম। পেটে খিদা নিয়েই হাটে-বাজারে চা পাতা বিক্রি করেছি। যখনই খিদা লাগতো হোটেলে গিয়ে পানি খেয়ে খিদার জ্বালা মেটাতাম। কাকে বলবো দুঃখের কথা। আমার পরিবার খুবই গরিব। দোকানে দোকানে ঘুরেছি একটি কাজের জন্য। একটা টেইলার্সের দোকানে পরিষ্কার-পরিছন্নতার কাজ নিলাম। সেখানে তারা আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এরপর লন্ড্রির দোকানে, তারাও প্রতারণা করল। এরপর ভাবলাম তেতুলিয়া থেকে চা পাতা এনে নিজেই প্যাকেটজাত করে বাজারে কম দামে বিক্রি করবো। কিন্তু চা কেনার মতো টাকা ছিল না। মাত্র ২০০ টাকার চা পাতা কিনে বাজারে বিক্রি করি। চা পাতার মান ভালো দেখে এক দোকানদার আমাকে চা পাতার অর্ডার দিলেন, কিন্তু চা কেনার মতো সামর্থ্য ছিল না। পরে আমার স্বামী ধার-দেনা করে আমার হাতে ৩ হাজার টাকা তুলে দিয়ে বলেন, “তুমি ব্যবসা কর”। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি আরও বলেন, যখন ব্যবসা শুরু করি তখন বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণের জন্য আবেদন করেছিলাম কিন্তু কোনো সংস্থা আমাকে ঋণ দেয়নি। এমনকি ঠাকুরগাঁও বিসিক শিল্প নগরীও না করে দেয়। পরে ধার-দেনা করে ব্যবসা বাড়ালাম, একটা সাইকেল কিনলাম। এখন জেলার প্রায় সবাই আমাকে চেনেন। যারা আমাকে নিয়ে কটু কথা বলতেন, তারাই এখন নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছেন। জীবনে এত দূর এসেছি সততার মাধ্যমে এবং পরিশ্রম করে। বর্তমানে আমার সাথী চা স্টোরে সাতজন নারী কাজ করেন। একজন নারী হয়ে আরেক নারীকে কাজের সুযোগ দিতে পেরে খুব আনন্দ অনুভব করছি। এত পরিশ্রম করার কারণ জানতে চাইলে সাথী বলেন, আমি আমার মা-বাবা ও স্বামীকে নিয়ে সুখে থাকতে চাই। এখন যেহেতু অভাব কিছুটা কমেছে, তাই আল্লাহ চাইলে ভবিষ্যতে সন্তান নিতে চাই। তা ছাড়া আমি সমাজের অবহেলিত নারীদের কাজের সন্ধান দিতে চাই। তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। চা ক্রেতারা বলছেন, কয়েক বছর থেকে আমরা ফরিদা পারভিন সাথীকে দেখে আসছি সাইকেলে করে চা পাতা নিয়ে দোকানে দোকানে বিক্রি করছেন। আমরাও তার কাছ থেকে স্বল্প মূল্যে চা পাতা নিই। সাথী চা খুবই ভালো। সাথী চা বিক্রি করে ক্রেতা পর্যায়ে চাহিদা বেড়েছে। একজন নারী হয়ে যেভাবে সাইকেলে করে চা বিক্রি করেন সেটা দেখে আমরা অবাক হয়ে যাই। তার এই কঠোর পরিশ্রম এক সময় সার্থক হবে। সাইফুল নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, সাথী নামে এই নারী প্রতিদিন দোকানে দোকানে চায়ের প্যাকেট বিক্রি করছেন। এটা দেখে অন্যদের শেখা উচিৎ। ইচ্ছা করলে বাসায় বসে থাকতে পারতেন কিন্তু তিনি তা না করে পরিশ্রম করছেন। রুবেল রানা নামে আরেক ক্রেতা বলেন, নারীরা যে সমাজের একটি অংশ, সাথী আপা তার উদাহরণ। তিনি মাত্র ২০০ টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন। আজকে লাখ টাকার ব্যবসা। সেখানে আবার সাতজনের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। তিনি যদি আর্থিকভাবে আরও কিছু সহযোগিতা পান তাহলে ভালো কিছু করতে পারবেন। সমাজের বেকার শিক্ষিত ও পরিশ্রমী নারীদের পাশে আমাদের সবার এগিয়ে আসা উচিত। তাহলেই নারীরা এগিয়ে যাবে। সাথীর স্বামী আব্দুল লতিফ বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী অনেক সংগ্রাম করেছি। এক বেলা খেলে আরেক বেলার চিন্তা করতাম। নিজের জায়গা-জমি বলতে কিছুই নাই। ভাড়া বাসায় থাকি। ধার-দেনা করে স্ত্রীকে চায়ের ব্যবসা ধরিয়ে দিয়েছি। বর্তমানে অন্ধকার কেটে আলো এসেছে। এ ব্যাপারে ঠাকুরগাঁও জেলা বিসিক শিল্পনগরী কার্যালয়ের উপব্যবস্থাপক হাফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মুঠোফোনে  বলেন, ফরিদা পারভিন সাথী চা পাতা প্রক্রিয়াজাত করে খোলা বাজারে বিক্রি করছেন। গত ১৬ ডিসেম্বরে বড় মাঠে আমাদের মেলা হয়েছিল সেখানে তিনি উদ্যোক্তা হিসেবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আমাদের কাছে একটি ঋণের আবেদন করেছেন, আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে তিনি এই ঋণ পেয়ে যাবেন।