নিজের নাবালক সন্তানের উপর টাকার জন্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে অমানবিকতার নজির গড়েছেন এক পাষণ্ড বাবা

নিজের নাবালক সন্তানের উপর টাকার জন্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে অমানবিকতার নজির গড়েছেন এক পাষণ্ড বাবা। নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে ওই কিশোর পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে পটুয়াখালীর গলাচিপায় খালার বাড়িতে। ঘটনাটি ঘটেছে গত শনিবার (২১ জুন)। বিষয়টি ঘটনার চারদিন পর বৃহস্পতিবার জানাজানি হলে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় নিরাপত্তা চেয়ে গলাচিপা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১০৭ ধারায় মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগী কিশোরের খালা নাজমা বেগম।

মামলা সূত্রে জানা যায়, ভুক্তভোগী কিশোরের নাম সামিউল ইসলাম (১২)। শিশুটির মা সালমা বেগম ২০২৪ সাল থেকে সৌদি আরবে থাকেন। ২০১৮ সালে সামিউলের বাবা মো. এরশাদ ও মা সালমা বেগমের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। বিচ্ছেদের পর সামিউল মায়ের কাছেই বড় হচ্ছিল। তবে কিছুদিন পর সুকৌশলে বাবা এরশাদ তাকে নিজের কাছে নিয়ে যান। এরপর শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। অভিযোগ উঠেছে, রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার বাসিন্দা মো. এরশাদ তার ছেলে সামিউলের উপর নিয়মিতভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাতেন। নির্যাতনের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রবাসী মা সালমা বেগমের কাছ থেকে মাসিক ভরণপোষণের টাকা আদায় করা। নির্যাতনে সহযোগিতা করতেন এরশাদের দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার দুই ভাই রেজাউল ও রিপন।

এসময় সালমা বেগম টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালেই সামিউলের উপর চলতো নির্যাতন। তাই ছেলের সুখের জন্য গর্ভধারিণী মা প্রতিমাসে বিদেশ থেকে টাকা পাঠাতো। কিন্তু হটাৎ এরশাদ সামিউলের মা সালমা বেগমের কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করেন। সালমা টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে সামিউলকে ধরে মারধর করে বাবা এরশাদ। লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়, খাবার থেকে বঞ্চিত করা হয়, এমনকি চিকিৎসাও করানো হয়নি। ভয়ভীতি দেখিয়ে সালমা বেগমের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করে এরশাদ। সামিউল জানায়, "আম্মুর কাছে আসতে চাইলে আমাকে ঘরে আটকে রাখা হতো। মা টাকা না দিলে বাবা মারধর করতো, খুব কষ্ট হতো।"

সামিউল, তার মা সালমা ও খালা নাজমা জানান,  অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে শনিবার ২১ জুন সামিউল রংপুরের বাবার বাড়ি থেকে পালিয়ে খালা নাজমা বেগমের বাড়ি, গলাচিপার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পথে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে মোবাইল ও টাকা হারিয়ে ফেলে সে। ছিনতাইকারীরা তাকে চেতনানাশক খাইয়ে অজ্ঞান করে ফেলে রেখে চলে যায়। পরে অজ্ঞান ও অসুস্থ অবস্থায় স্থানীয়রা সামিউলকে পটুয়াখালী সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। খোঁজাখুজির পর ঘটনার একদিন পরে খবর পেয়ে খালা নাজমা বেগম তাকে হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে যান। বর্তমানে সামিউল খালার বাড়িতেই অবস্থান করছে এবং সেখানে থাকতে চান।

কিন্তু এদিকে পুরো বিষয়টিকে আড়াল করতে সামিউলের বাবা এরশাদ উল্টো খালা নাজমা বেগমের বিরুদ্ধে মিঠাপুকুর থানায় একটি মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেন। তিনি দাবি করেন, খালা জোর করে সামিউলকে নিয়ে গেছেন, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছেন সামিউলের মা ও খালা। তারা আইনের আশ্রয় চেয়ে ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছেন।

খালা নাজমা বেগম বলেন, "সামিউল নিজের ইচ্ছায় আমার কাছে এসেছে। ছেলেটি খুব কষ্টে ছিল। এখনো ভয়ে কাঁপে। ফোন করে প্রায়ই কান্নাকাটি করতো, বাবা ও সৎমার নির্যাতনের কথা বলতো। আমরা সবসময় বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে রাখছি। কিন্তু মারধর সহ্য করতে না পেরে সে না বলে চলে আসছে। আমরা ওর নিরাপত্তা চাই।"

মা সালমা বেগম বলেন,"আমি বিদেশে থাকি, কিন্তু ছেলের জন্য প্রতিমাসে টাকা পাঠাতাম। এখন পাঁচ লাখ টাকা চাইছে আমি দিতে পারিনি তাই আমার ছেলেকে মারধর করেছে। এরশাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।"

সামিউল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, "আমি আর বাবার কাছে যাবো না। তারা আমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে। টাকা না পেলে মারধর করে, আমাকে খেতে দেয় না। আমি অনেক কষ্ট পাই। এখন আমি শান্তিতে থাকতে চাই, খালার কাছেই থাকবো।"

বাবা এরশাদের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

এদিকে একজন বাবার কাছ থেকে সন্তানের প্রতি এমন অমানবিক আচরণ শুধু পারিবারিক নয়, এটি সমাজের মানবিকতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিকরা। তারা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি দাবি জানিয়েছেন —শিশুটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক এবং দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।