কৃষিতে নিষিদ্ধ বিপদজনক কীটনাশকের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এর ফলে হুমকিতে পড়েছে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ। বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ করা কীটনাশক জেনেরিক  নাম ঠিক রেখে শুধুমাত্র নাম পরিবর্তন করে  কৌশলে হরহামেশাই বিক্রি করছে দোকানিরা।  জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এসব কীটনাশক না বুঝেই কিনে জমি ও ফল-ফুলে ব্যবহার করছেন কৃষকরা। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এগুলো নিষিদ্ধ। এতে করে কৃষকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তেমনিভাবে ঝুঁকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ। পরিসংখ্যান বলছে ৬৮  শতাংশ মানুষ নিষিদ্ধ বালাইনাশক ব্যবহারে   ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর ৯৩.৩৭ শতাংশ মানুষ জানেই না যে তারা নিষিদ্ধ বিপদজনক বালাইনাশক ব্যবহার করছেন।
"কৃষি প্রধান বরেন্দ্র জনপদে নিষিদ্ধ কীটনাশকের ভয়াবহ প্রভাব : ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ"  শীর্ষক মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানমূলক সমীক্ষার ফলাফলে এমন ভয়াবহ তথ্য তুলে ধরেছেন  বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজ ( বারসিক)। বুধবার সকালে রাজশাহী নগরীর একটি হোটেলের কনফারেন্স হলে  সংবাদ সম্মেলন করে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন আঞ্চলিক সমন্বয়ক নৃবিজ্ঞানী মো:শহিদুল ইসলাম। কীটনাশক ব্যবহারের প্রেক্ষাপট ও ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন বারসিক'র নির্বাহী পরিচালক পাভেল পার্থ।
সংস্থাটি বলছে গবেষণাটি ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে রাজশাহী জেলার ৮টি উপজেলার ১৯ টি কৃষি প্রধান গ্রামঅঞ্চলে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ,  ভুক্তভোগীদের কেস স্টাডি এবং স্থানীয় কীটনাশক ডিলার, দোকানদার, কীটনাশক পরিবেশক ও উপজেলা পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা সহ বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে।
গবেষণার সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ৩২ জন ক্ষতিগ্রস্ত ভুক্তভোগী তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, ৬৮ শতাংশ কৃষক নিষিদ্ধ কীটনাশক ব্যবহার করছেন। বিভিন্ন কীটনাশক দোকানে এসব অবাধে বিক্রি হচ্ছে।  ৯৩.৩৭ শতাংশ  কৃষক জানেন না এগুলো নিষিদ্ধ বিপদজনক কীটনাশক।  তারা জানান, গবেষণা এলাকা থেকে প্রাপ্ত কিছু নিষিদ্ধ কীটনাশক পাওয়া গেছে যা ভিন্ন ভিন্ন লেবেলে বিক্রি হচ্ছে। যেমন, জিরো হার্ব ২০ এস এল( জেনেরিক নাম- প্যারাকোয়াট), ফুরাডান-৫ জি (ফুরাডান কার্বোরাইল), এরোক্সান ২০ এস এল ( প্যারাকোয়াট), গ্যাস ট্যাবলেট ( অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড), কার্বোফোরান ৩ জি এসিআই( কার্বোফোরান), ইদুর মারা বিষ ( ব্রডিফ্যাকোয়াম),তালাফ ২০ এস এল ( প্যারাকোয়াট)  ইত্যাদি । 
গবেষণা ফলাফলে আরো বলা হয়েছে শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে  এমন কীটনাশক  ব্যবহার করছে শতকরা ১৯ শতাংশ কৃষক।  যদিও কিছু  বালাইনাশক  সীমিত আকারে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
ফসলে হরমোন, ভিটামিন ব্যবহার নিরাপদ বলা হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ডাডব্লিউএইচও সহ  বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বলছে এসব ব্যবহারে মানুষ সহ  জীববৈচিত্র্যের স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। এ সমস্ত ভিটামিন হরমোন ব্যবহারের ফলে ৯ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গবেষণা এলাকায় প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে দেখা যায়  শতকরা ৯৯ ভাগ কীটনাশক বিক্রেতাদের  দোকানেই নিষিদ্ধ কীটনাশক গুলো বিভিন্ন নামে পাওয়া যাচ্ছে।  কোম্পানির প্যাকেটের গায়ে ভিন্ন নাম থাকলেও তার জেনেরিক নাম বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সেগুলো কোনোটি একেবারেই বাংলাদেশের নিষিদ্ধ, আবার কোনোটি বিশেষ নিয়ন্ত্রণে স্বল্পমাত্রায় ব্যবহারের জন্য বা নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের জন্য বলা হয়েছে।  কিন্তু কৃষকরা এগুলো না জেনে বা বুঝে জমি ও ফসলে প্রয়োগ করছেন।  ফলে ব্যবহারকারী প্রায় সকলেই কিডনি বিকলতা, স্নায়ুবিক ক্ষতি, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা,  বমি সহ নানা স্বাস্থ্যগত জটিলতায় ভুগছেন। মাঠ ভিত্তিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সমস্ত বালাই নাশক ব্যবহারে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে তার মধ্যে অন্তত ৮টি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা কর্তৃক অত্যন্ত বিপদজনক  কীটনাশক হিসেবে চিহ্নিত এবং বহু দেশে নিষিদ্ধ। গবেষণায় দেখা গেছে কীটনাশকের সহজলভ্যতা ও অনিয়ন্ত্রিত বিক্রয়ের ফলে শুধু জনস্বাস্থ্য নয়  আত্মহত্যার একটি প্রধান মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। তথ্য বলছে ৩২ জনের মধ্যে তিনজনই আত্মহত্যা করার জন্য কীটনাশক পান করেছিলেন।
এছাড়াও কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে পরিবেশের প্রতিও মারাত্মক ক্ষতির প্রভাব ফেলছে।  মাটি পানি ও প্রাণ বৈচিত্র ধ্বংসের জন্য বড় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি পুকুরের মাছ, ব্যাঙ ও মৌমাছির উপর প্রভাব পড়ছে।
মাঠ পর্যায়ে কীটনাশক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সরকারের পেস্টিসাইড আইন ২০১৮, কীটনাশক বিধিমালা ২০১৯ অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণে  আইন প্রয়োগসহ নিষিদ্ধ কীটনাশকের বিপণন ও ব্যবহার কঠোরভাবে বন্ধ করা, মাঠ পর্যায়ে মনিটরিং বাড়ানো, গ্রাম সহ সকল পর্যায়ে কীটনাশক সম্পর্কিত স্বাস্থ্য তথ্য নিবন্ধন পদ্ধতি চালু করা, পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতিকরণ সকল কীটনাশক নিষিদ্ধ করা,  বিকল্প কৃষি প্রতিবেশবিদ্যা বিষয়ক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা চর্চায় সরকারি সহায়তা ও প্রণোদনা বাড়ানো ,  ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠন এবং  কীটনাশকের ক্ষতিকর দিক ও ভয়াবহতা সম্পর্কে মিডিয়া,স্কুল ও সামাজিক সংগঠনসমূহের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার  সুপারিশ করা হয়।