সাম্প্রতিক সাভারের নৃশংস হত্যাকাণ্ড যেন এক ভয়ংকর বার্তা দেয়। পিতার হত্যাকারী জান্নাত আরা শিফার সমকামী পরিচয় ও মাদকাসক্ত সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক ভয়াবহ ব্যাধির স্বরূপ উন্মোচন করেছে

সাম্প্রতিক সাভারের নৃশংস হত্যাকাণ্ড যেন এক ভয়ংকর বার্তা দেয়। পিতার হত্যাকারী জান্নাত আরা শিফার সমকামী পরিচয় ও মাদকাসক্ত সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক ভয়াবহ ব্যাধির স্বরূপ উন্মোচন করেছে। এই বিচ্ছিন্ন ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান সমকামিতা ও এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের অস্বাভাবিক জীবনযাপন নীরবে আমাদের সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কতটা মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এখনই প্রতিরোধ না করলে এই বিষাক্ত স্রোত সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করবে, ধ্বংস করবে আমাদের চিরায়ত মূল্যবোধ ও পারিবারিক কাঠামো।

দীর্ঘদিন ধরে সচেতন মহল সামাজিক মাধ্যমে সমকামিতা ও এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জনসচেতনতামূলক লেখালেখি করে আসছেন। তাদের সেই আশঙ্কা আজ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা ও উদাসীনতার সুযোগে এই অস্বাভাবিক প্রবণতা বিস্তার লাভ করছে। অতিরিক্ত শান্ত, খেলাধুলাবিমুখ অথবা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আগ্রহহীন সন্তানের অস্বাভাবিক আচরণ প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে সমকামিতা বা বিকৃত যৌনতার শিকার হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে। ছেলেদের ছেলেসুলভ স্বাভাবিক আচরণ এবং মেয়েদের নারীসুলভ শালীনতাবোধ যখন লোপ পায়, তখনই বিপদের ঘণ্টা বাজে। সাভারের জান্নাত আরা শিফার ঘটনা তারই ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। মাদকাসক্ত, সমকামী এবং বিকৃত যৌনাচারে নিমজ্জিত শিফা শুধু তার বাবাকেই নির্মমভাবে হত্যা করেনি, বরং সেই নৃশংসতার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে চরম ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। তদন্তে জানা যায়, হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে সে তার বাবার বিরুদ্ধে মিথ্যা ধর্ষণের অভিযোগও এনেছিল। এমন পৈশাচিকতা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে কল্পনাও করা যায় না।

এই ভয়ংকর ঘটনা স্পষ্ট করে দেয়, সমকামিতা কেবল একটি ‘ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়’ নয়, এটি একটি ভয়াবহ সামাজিক অবক্ষয়ের লক্ষণ। এখনই যদি এর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সোচ্চার হওয়া না যায়, তবে শিফার মতো আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে—অভিভাবক, শিক্ষক, সচেতন নাগরিক—এই হুমকির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

বাংলাদেশে সমকামিতার ক্রমবর্ধমান বিস্তার: এক নীরব বিপ্লব?

বিভিন্ন গবেষণা ও সামাজিক পর্যবেক্ষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে সমকামিতার বিস্তার ক্রমশ বাড়ছে। পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ, সহজলভ্য পর্নোগ্রাফি ও মাদকের বিস্তার এবং সামাজিক সচেতনতার অভাব এই প্রবণতাকে ইন্ধন যোগাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে এই বিকৃতির শিকার হচ্ছে। বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও গে-ডেটিং অ্যাপসের মাধ্যমে সমকামী সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্ম দিচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশ সাইবার ইউনিটের ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে অন্তত ৩৭টি সক্রিয় এলজিবিটিকিউ ফোরাম ও গ্রুপ রয়েছে, যাদের সদস্য সংখ্যা ৩০,০০০ ছাড়িয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা “সমাজ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র” (SOC) ২০২৪ সালের জরিপে জানায়, ঢাকা ও চট্টগ্রামের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮-২৮ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রায় ৫.২% শিক্ষার্থী সমকামী আচরণে জড়িত। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের ২০২২ সালের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশে এলজিবিটিকিউ+ পরিচয়ের মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পারিবারিক বন্ধনের অভাব, সঠিক নৈতিক শিক্ষার অভাব এবং মাদকের সহজলভ্যতা তরুণদের বিপথগামী করছে। অনেক ক্ষেত্রেই সন্তানের অস্বাভাবিক আচরণ দেখেও অভিভাবকরা তা গুরুত্ব দেন না অথবা লোকলজ্জার ভয়ে বিষয়টি চেপে যান। এই নীরবতা প্রকারান্তরে বিপদকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

প্রতিরোধের সম্মিলিত পদক্ষেপ:

এই ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি থেকে সমাজকে রক্ষা করতে জরুরি ভিত্তিতে সম্মিলিত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে:

  • প্রযুক্তির দায়িত্বপূর্ণ ব্যবহার: সন্তানদের ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। ক্ষতিকর ওয়েবসাইট ও অ্যাপসের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং Parental Control App ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে।

  • পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করা: সন্তানদের সঙ্গে নিয়মিতভাবে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। তাদের মানসিক ও আবেগিক চাহিদা বুঝতে হবে এবং তাদের সঠিক পথে চালিত করতে হবে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট সন্তানের জন্য সময় বের করা অপরিহার্য।

  • নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পরিবারে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। পাঠ্যক্রমে নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত।

  • সচেতনতা বৃদ্ধি ও সামাজিক প্রতিরোধ: সমকামিতা ও এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের অস্বাভাবিক জীবনযাপন সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে অবগত করতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।

  • আইনগত পদক্ষেপ ও কঠোর প্রয়োগ: সমকামিতাকে উৎসাহিত করা ওয়েবসাইট ও গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এই ঘৃণ্য প্রবণতার সাথে জড়িত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা জরুরি।

  • মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও পুনর্বাসন: যারা এই বিকৃতির শিকার, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

মনোবিজ্ঞানী ড. নাসির উদ্দিন খান মনে করেন, “তরুণদের মনস্তত্ত্ব খুব দ্রুত প্রভাবিত হয়। তারা যা দেখে, তাই ভাবতে শেখে। সেক্ষেত্রে প্রযুক্তির ভুল ব্যবহারে তারা বিকৃত যৌনতা, লিঙ্গ বিভ্রান্তি ও সমকামী আচরণে জড়িয়ে পড়ছে। অভিভাবকদের উচিত, বন্ধুর মতো সন্তানের সঙ্গে কথা বলা ও মনস্তাত্ত্বিক যোগাযোগ স্থাপন করা।”

সমকামিতা কোনো ‘স্বাধীন পছন্দ’ নয়, এটি একটি মারাত্মক মানসিক ও সামাজিক ব্যাধি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ধর্ম ও নৈতিকতাকে রক্ষা করতে হলে আমাদের এখনই সোচ্চার হতে হবে। এখনই যদি আমরা সম্মিলিতভাবে এই হুমকির বিরুদ্ধে না দাঁড়াই, তবে আমাদের সমাজ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক অন্ধকার গহ্বরের দিকে ধাবিত হবে। আসুন, আমরা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হই এবং আমাদের সমাজকে এই ভয়াবহ ব্যাধি থেকে রক্ষা করি। মনে রাখতে হবে, “সমাজকে যদি সুস্থ রাখতে চান, তাহলে ‘অস্বাভাবিকতাকে’ স্বাভাবিক করে দেখার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।”