১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর জন পিটার গ্র্যান্ট রেলওয়ে নির্মাণকাজ পরিদর্শনের জন্য স্টিমারযোগে পাবনায় আসেন

১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর জন পিটার গ্র্যান্ট রেলওয়ে নির্মাণকাজ পরিদর্শনের জন্য স্টিমারযোগে পাবনায় আসেন। তিনি কুমার ও কালীগঙ্গা নদীপথে ৬০/৭০ মাইল পথ অতিক্রম করে পাবনায় এসেছিলেন। তার যাত্রাকালে হাজার হাজার চাষী নদীর দুই তীরে সারিবদ্ধভাবে অবস্থান নেয়। এদের মধ্যে চাষি পরিবারের নারী ও শিশুরাও ছিল। হাজার হাজার মানুষ লেফটেন্যান্ট গভর্নরের নিকট নীলচাষের কবল থেকে মুক্তি চায়। তারা তাদের শরীরের  অত্যাচারের চিহ্ন দেখার জন্য তার প্রতি আবেদন জানায়। চাষিরা চিৎকার দিতে থাকে যে, 'তারা তাদের শাসকের সামনে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরবে, তবুও নীলচাষ করবে না। '৪৩ চাষিরা স্টিমারে আক্রমণ চালাবে মনে করে গ্র্যান্ট ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তবে শীঘ্রই তার এ ধারণা ঘুচে যায়। কয়েকজন চাষি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরিয়ে স্টিমারে ওঠে। গ্র্যান্ট ধৈর্যের সাথে তাদের মুখ থেকে নীলকরের লোমহর্ষক অত্যাচারের কাহিনী শোনেন। তিনি চাষিদের দু-এক দিনের মধ্যে পাবনায় সাক্ষাৎ করার পরামর্শ দেন। তিনি বিষয়টি দেখবেন বলেও চাষিদের আশ্বাস দেন। নীলচাষের এলাকাসমূহে খবর ছড়িয়ে পড়ার পর হাজার হাজার মানুষ নীলকরের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দরখাস্ত নিয়ে পাবনা অভিমুখে যাত্রা করে। পাবনায় চাষিদের আগমন ঠেকাবার জন্য নীলকরের লাঠিয়ালরা পথ রোধ করে বসে। কিন্তু চাষিদের দৃঢ়তা এবং সংখ্যার কারণে লাঠিয়ালদের পক্ষে তাদের ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। হাজার হাজার চাষি লেফটেন্যান্ট গর্ভনরের সঙ্গে দেখা করতে পাবনায় আসে। গ্রান্ট তাদের দরখাস্ত জমা দেয়ার এবং মৌখিকভাবে তাদের অভিযোগ বর্ণনা করার আদেশ দিলে তারা নীলকরদের অত্যাচারের সবিশেষ বিবরণ দেয়। সেই সঙ্গে সবাই নীলচাষের নাগপাশ থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য গ্র্যান্টের প্রতি আবেদন জানায়। চাষিরা এতো বেশি দরখাস্ত জমা দেয় যে, লেফটেন্যান্ট গভর্নরের চেয়ারের দুই পাশে দরখাস্তের স্তূপ জমা হয়। গ্র্যান্ট অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি ঘোষণা দেন, 'চাষিদের ইচ্ছা না থাকলে তাদের নীলচাষ করতে হবে না। ৪৪ গ্র্যান্টের এই ঘোষণা চাষিদের নীল আন্দোলনে বিশেষভাবে উৎসাহিত করে।

উল্লেখ্য, নীলচাষ আরম্ভ হলে জমিদাররা নীলকরদের জমি পত্তনি দিয়ে লাভবান হয়। এ পার্যায়ে তার নীলকরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ায়। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে নীলকররা এদেশে ভূস্বত্তাধিকারের অধিকার পেয়ে জমিদার হয়ে বসলে জমিদাররা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রেণি হিসেবে দেখতে পায়। নীলকরেরা জমির মালিক হয়ে বসলে তাদের জমিদারের নিকট থেকে আর জমি পত্তনি নিতে হয়নি। ফলে নীলচাষ জমিদারদের জন্য আর লাভজনক থাকেনি। পাবনা জেলার নীলকরদের বিরোধিতাকারী জমিদারদের মধ্যে নড়াইল পরিবারের রামরতন রায়, পাংশার জমিদার ভৈরব চন্দ্র মজুমদার, শালঘর মধুয়ার প্যারী সুন্দরী এবং তাঁতিবন্দের জমিদার বিজয় গোবিন্দ চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। এরা চাষিদের পক্ষে আদালতে মামলা দায়ের করে। সেই সঙ্গে মাঠে লাঠিয়াল দিয়ে নীলকরের বিরুদ্ধে চাষিদের সহায়তা করে। এছাড়া তারা নীলকরদের বিরুদ্ধে চাষিদের সংগঠিত করারও প্রয়াস পায়।

দেশের বিভিন্ন স্থানে চাষিদের বিদ্রোহ, আন্দোলন, মামলা-মোকদ্দমার ফলে নীল আন্দোলনের কারণ অনুসন্ধানের জন্য সরকার 'ইনডিগো কমিশন' নিয়োগ করে। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিশনের সভাপতি ছিলেন ব্রিটিশ সিভিলিয়ন সিটন-কার। অন্য চার সদস্য ছিলেন যথাক্রমে রিচার্ড টেম্পল (সরকার মনোনীত), জেমস ফোরলঙ -(নীলকর), চন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায় (জমিদার) এবং রেভারেন্ড জে. সেল (পাদরি)। ৭০ ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে গঠিত এই কমিশন নীলকর, জমিদার, কর্মকর্তা, পাদরি এবং চাষিদের সাক্ষ্য নেয়। পাবনা জেলা থেকে কমিশনে সাক্ষ্য দেন তাঁতিবন্দের জমিদার বিজয় গোবিন্দ চৌধুরী, জয়দিয়া থানার বারাদি গ্রামের জোতদার ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরী, দড়িপাড়া গ্রামের চাষি আদম মণ্ডল এবং পাবনা সদরের মেঘনা গ্রামের চাষি কমলকান্ত মালাকার প্রমুখ। ৭১ সাক্ষ্য গ্রহণ ও তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে কমিশন ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে ৭৬২ পাতার প্রতিবেদন জমা দেয়। ৭২ নীল-কমিশনের প্রতিবেদনে নীলকরের শোষণ ও অত্যাচারের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। চাষিদের সংগঠিত হওয়া ও দৃঢ়তার কারণে সরকার নীলচাষ চাষির ইচ্ছাধীন বলে ঘোষণা করে। এর ফলে চাষিরা নীলচাষ ত্যাগ করলে জেলায় নীল-উৎপাদন কমে আসে। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের পরে জেলায় মাত্র ৫,০০০ একর জমিতে ৪০০ মণ নীল উৎপন্ন হতো। ক্রমান্বয়ে তা আরো হ্রাস পায় এবং শেষাবধি জেলা থেকে নীলচাষের অবসান ঘটে।