বীর মুক্তিযোদ্ধা অনা: ক্যাপ্টেন মো.আফজাল হোসেন শিকদার (বীর বিক্রম) এর আজ দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকী। ২০২৩ সালের ১১ আগস্ট যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ২নং সেক্টরে, সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের অধীনে কুমিল্লা অঞ্চলে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিসরূপ তাঁকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়।


মো. আফজাল হোসেন শিকদার ১৯৪০ সালের ১ ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির খুলনার নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার কাশিপুরের গণ্ডব গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম জসিমউদ্দিন শিকদার মাতার নাম মরহুমা আয়মনা খাতুন। তিনি ১৯৫৮ সালে লোহাগড়া যদুনাথ মজুমদার একাডেমি থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগ দেন। তিনি ১৯৬৪ সালে ল্যান্স নায়েক এবং ১৯৬৫ সালে নায়েক পদে উন্নিত হন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। তখন তিনি সেকেন্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টে রংপুর লালমনিরহাটে অবস্থান করেন এবং দহগ্রাম আংগোরপোতা বর্ডার দিয়ে ভারতের দিকে মার্চ করেন। উল্লেখ্য এই বর্ডারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বোমা বর্ষণ করেছিলো। এ যুদ্ধে তিনি বীরত্বের পরিচয় দেন। 

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আফজাল হোসেন শিকদার ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তখন তিনি চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাঙালির হাতে ক্ষমতা না দিয়ে অস্ত্র সজ্জিত করতে থাকে এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দেড় লক্ষ সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েন করেন। সারা দেশে তারা বাঙালি পুলিশ বিডিআর সেনাবাহিনীদের নিরস্ত্র করার জন্য ২৫ মার্চ রাত ১১টা থেকে আক্রমণ শুরু করে। এ সময় আফজাল হোসেন শিকদারের ব্যাটালিয়ন কুমিল্লায় ছিল। তখন তিনি ছিলেন রিয়ার পার্টির সিনিয়র এনসিও। পাকিস্তানিরা তাদের ডিউটি বন্ধ করে নিরস্ত্র করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাঙালি সৈন্যরা রাজি না হওয়ায় পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের উপর আক্রমণ করে। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ বিকাল ৪টায় যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধের ঘটনা বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজা হোসেনের কাছ থেকে জানা যায়, "২৭ মার্চ বিকাল থেকে যুদ্ধ শুরু হয়। আমার গ্রেনেড নিক্ষেপে ১৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায়। এক পর্যায়ে আমি পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হই। তখন মনে মনে ভাবতে থাকি,'কত প্রশিক্ষণ নিলাম কমান্ডো কোর্স করলাম, যদি একজন পাকিস্তানি সৈন্য না মেরে মারা যাই তাহলে দেশের জন্য কোন কাজে লাগলাম না ' আর চিন্তা করলাম, 'যুদ্ধ করে জীবন দেবো তবু কয়েদ হবো না'। ১০/১২ জন সৈন্য আমাকে ধরে জিজ্ঞেস করে বাকি সৈন্যরা কোথায়। আমি বলি ওরা মেস হাউজের চর্তুদিকে আছে। আমি বাঁচার জন্য এই কৌশল নিয়েছিলাম। সৈন্যরা তাদের খুজতে চলে গেলো আর একজনকে রেখে গেল আমাকে ধরে রাখার জন্য। আমি জানতাম এটাই হবে আর একজন আমাকে ধরে রাখতে পারবে না। তাই হলো সুযোগ বুঝে আমি ওকে প্রচন্ড জোরে আঘাত করলাম। সে মাটিতে পড়ে গেলো। তার নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। সে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো। পাশেই আমার হাতিয়ার ও গ্রেনেড রাখা ছিল । আমি বেরিয়ে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হলাম। সামনে পাকিস্তানি সৈন্য দেখে গ্রেনেড নিক্ষেপ করি। কয়েকজন স্পটে মারা যায় বাকিরা গড়াতে গড়াতে পাহাড়ের নিচে পড়ে যায়। রাত ৮ টা পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে জানজুয়া কোম্পানির ক্যাপ্টেন সাইদ সহ ৩৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায় এবং ১৭ জন আহত হয়। আমাদের ৯ জন শহীদ হয় আর ১৪ জন বন্দী হয়। আমারা ২৫ জন বের হয়ে আসতে সক্ষম হই। ক্যান্টনমেন্টের পশ্চিম পাশে ওলিপুর গ্রামে আমরা আশ্রয় নেই। সেখানে একজন নায়েক তার নাম ওয়ালিয়ার সে আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে। পরের দিন আমি ছদ্মবেশে ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে ৩৭ জনের কবর দেখতে পাই এবং ওয়ার্কসপে গিয়ে জানতে পারি ১৭ জন হাসপাতালে ভর্তি আছে"। 
তিনি আরো বলেন, "কুমিল্লা থেকে আমার দলবল নিয়ে সিলেটের তেলিয়াপাড়া পৌঁছাই। তেলিয়াপাড়ায় আমার কোম্পানি অবস্থান করছিলো। তেলিয়াপাড়া চা বাগানের পাশেই বড় মসজিদ ছিলো। আমরা যখন ওখানে পৌঁছাই। তখন দেখলাম ২৭ মার্চ কুমিল্লার যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছে তাদের জন্য মিলাদ শেষ করে লোকজন বের হচ্ছে। একজন হাবিলদার আমাকে জানালো যাদের জন্য আমরা দোয়া করেছি তার মধ্যে আপনার নামও আছে, কি আশ্চর্য আপনি আমার সামনে দাড়িয়ে! বাকি সবাই আমাকে দেখে অবাক হলো। এরপর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি সব ঘটনা শুনে আমাকে অভিবাদন জানালেন। খালেদ মোশাররফ আমাকে ব্যাটালিয়ন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সাইড দেখার দায়িত্ব দিলেন"।

এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে আগরতলা একটি মিটিং হয়। ঐ মিটিংয়ে সকল অফিসার জেনারেল ওসমানী সহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। মিটিয়ে ৮ টি সেক্টরের কথা বলা হলো, কোন সেক্টরে কে দায়িত্বে থাকবে তা নির্ধারণ করা হলো। আফজাল হোসেন শিকদারের ব্যাটালিয়নকে ২ং সেক্টরের অধীনে কুমিল্লা পাঠানো হয়। খালেদ মোশাররফ সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন। বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন শিকদার কুমিল্লার বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। অসংখ্য পাকিস্তানি সৈন্য তার অপারেশনে মৃত্যু বরণ করেছে। 
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোস্তফা কামালের সাথে তিনি একই ব্যাটালিয়নে যুদ্ধ করেছেন। আখাউড়ার সালথা নদীর পাশে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়। ৭ বা ৮ এপ্রিল, এই যুদ্ধে মোস্তফা কামাল শহীদ হন। মোস্তফা কামাল আলফা কোম্পানিতে ছিলেন। খানা খাওয়ার সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রমণ করে। মোস্তফা কামাল বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন। তার বীরত্ব দেখে পাকিস্তানি এক অফিসার মন্তব্য করেছিলেন, " পাকিস্তানি সৈন্য হলে তাকে 'নিশান-ই-হায়দার' উপাধি দেওয়া হতো"।
মো.আফজাল হোসেন শিকদার মে মাসের শেষের দিকে বুড়িচং দেবীদ্বার মুরাদনগর এই তিন থানার কমান্ডার নিযুক্ত হন। এখানে অসংখ্য যুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দেন।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিসরূপ তাকে বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর যোদ্ধা নড়াইলের কৃতি সন্তান বীর বিক্রম মো. আফজাল হোসেন শিকদার এর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।