মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক গভীর করার জন্য যে সকল বিষয় অনুসরণ করা প্রয়োজন ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী

মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক গভীর করার জন্য যে সকল বিষয়  অনুসরণ করা প্রয়োজন ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী।  শ্রমিক দিবস উপলক্ষে তার একটি চমৎকার  রুপরেখা তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ ইসলামি  ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি  অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমান। 

"ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ হিসেবে অন্যান্য সকল দিকের মতো শ্রমজীবী মানুষদের সকল সমস্যার সার্বিক ও ন্যায়ানুগ সমাধানের দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। ইসলাম চায় শ্রমিক ও মালিকের সৌহার্দপূর্ণ পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে এমন এক বিধানের প্রচলন করতে, যেখানে শ্রমিক শ্রেণিকে শোষণ-নিপীড়নে পিষ্ট করার জঘন্য প্রবণতা থাকবে না। ইসলামের নির্দেশনা মেনে মালিক শ্রমিকের অধিকার শতভাগ পূরণ করবে এবং শ্রমিকরা মালিকের প্রতি তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য সুচারুরূপে সম্পাদন করবে। ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক ও মালিকের পারস্পরিক সম্পর্ক ভৃত্য-মনিবের সম্পর্ক নয়, বরং ভ্রাতৃত্বের ও সাহায্যকারীর। নিজের পরম আত্মীয়ের মতোই শ্রমিকের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ করা, পরিবারের সদস্যদের মতোই তাদের আপ্যায়ন করা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার প্রতিটি মুহূর্তের প্রতি খেয়াল রাখা এবং তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করাকে ইসলাম মালিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে শামিল করেছে।

রাসূলুল্লাহ বলেছেন, 'আপন সন্তান-সন্ততির মতো শ্রমিকদের মান-সম্মানের সাথে তত্ত্বাবধান করো। আর তাদের তা খেতে দেবে, যা তোমরা নিজেরা খেয়ে থাকো।' [ইবনে মাজাহ]

মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শ্রমিককে আপনজনের সাথে তুলনা করে বলেছেন, 'তোমরা তোমাদের আপনজন ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যেমন ব্যবহার করো, তাদের সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করবে।' একই কথা মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরেক হাদীসে উল্লেখ আছে এভাবে, 'তোমরা অধীনদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে এবং তাদেরকে কোনো রকমের কষ্ট দেবে না। তোমরা কি জানো না- তাদেরও তোমাদের মতো একটি হৃদয় আছে। ব্যথা দানে তারা দুঃখিত হয় এবং কষ্টবোধ করে। আরাম ও শান্তি প্রদান করলে সন্তুষ্ট হয়। তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা তাদের প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শন কর না।' সহীহ বুখারী]

মালিকরা তাদের অধীন শ্রমিকদের সঙ্গে কীরূপ আচরণ করবে, সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'এরা (শ্রমিকরা) তোমাদের ভাই, আল্লাহ এদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। অতএব, আল্লাহ তাআলা যে ব্যক্তির ভাইকে তার অধীন করে দিয়েছেন, তার উচিত- সে যা খাবে, তাকেও তা খাওয়াবে। সে যা পরবে, তাকেও তা পরাবে। আর যে কাজ তার পক্ষে সম্ভব নয়, সে কাজের জন্য তাকে কষ্ট দেবে না। আর যদি

কষ্ট দেয়, তাতে নিজেও তাকে সাহায্য করবে।' [সহীহ বুখারী। ইসলাম মালিককে সহনশীল হতে শিক্ষা দেয় এবং শ্রমিকের দোষত্রুটি ক্ষমা করে দিতে উৎসাহিত করে। শ্রমিকের প্রতি মালিক যাতে সহনশীল থাকে এবং তার ভুল-ত্রুটি ক্ষমার মতো মহৎ মনের অধিকারী হয়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীসে বলেছেন, 'মজুর-চাকরদের অপরাধ অসংখ্যবার ক্ষমা করা মহত্ত্বের লক্ষণ।'

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিআল্লাহু আনহু বলেছেন, 'এক ব্যক্তি নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে জিজ্ঞেস করলেন, "ইয়া রাসূলুল্লাহ! চাকর-বাকরের অপরাধ আমি কতবার ক্ষমা করব?" রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুপ রইলেন। সে পুনরায় তাঁকে প্রশ্ন করলে এবারও চুপ রইলেন তিনি। সে পুনরায় তাকে প্রশ্ন করলে এবারও চুপ রইলেন। চতুর্থবার বলার পর বললেন, "প্রত্যেক দিন সত্তরবার তাকে ক্ষমা করবে।"" [আবু দাউদ) মালিকের অভদ্র আচরণকে ঘৃণা করে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'অসদাচরণকারী মালিক জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।' [সহীহ তিরমিযি] রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের জীবনে এ আদর্শগুলো বাস্তবায়ন করে মানবজাতির নিকট দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন। নবীজির একান্ত খাদেম আনাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, 'আমি নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অধীনে দশ বছর কাজ করেছি, তার খেদমত করেছি। কিন্তু তিনি কোনোদিন আমাকে ভর্ৎসনা করেননি। কোনোদিন বলেননি, "এটা এভাবে কেন করেছ, ওটা ওভাবে কেন করোনি?"" [সহীহ বুখারী।

নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মালিকদের উৎসাহিত করতে গিয়ে বলেন, 'যাদের মধ্যে তিনটি গুণ আছে, তাদের মৃত্যু অত্যন্ত সহজ হবে এবং তাদেরকে আল্লাহ পাক জান্নাত দেবেন। সে তিনটির মধ্যে একটি হলো অধীনদের সাথে সদ্ব্যবহার এবং তাদের প্রতি অনুগ্রহ করা।' অনেক সময় শ্রমিকদের কিছু কিছু আচরণের কারণে মালিকের মন বিষণ্ণ ও রাগান্বিত হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখনও তাকে শান্ত থাকতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, 'যে ব্যক্তি প্রতিশোধ নিতে পারার ক্ষমতা সত্ত্বেও নিজের ক্রোধকে দমন করতে পারে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তার মন প্রশান্তি ও ঈমানের দ্বারা পূর্ণ করে দেবেন।' [আবু দাউদ] ইসলাম বলেছে- শ্রমিকরা যদি তাদের অধিকার দাবি না-ও করে, তবুও মালিককে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তা আদায় করে দিতে হবে। নইলে তাকে জবাবদিহি করতে হবে আল্লাহর কাছে। মালিক সবসময়ই শ্রমিকের কাছ থেকে অধিক কাজ নিতে চায়। ইসলাম মালিকের অন্তর থেকে এই মনোভাব বিদূরিত করে দেয়। নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'তুমি তোমার খাদেমের কাজ সহজ (হালকা) করে দিয়ো, তাহলে কেয়ামতের দিন আল্লাহ পাক তোমাকে এর প্রতিদান দেবেন।' হায়ছামী]

🔸ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিকের প্রাপ্য অধিকার

শ্রমিকের অধিকারে ইসলাম যতটা গুরুত্ব দিয়েছে, পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম বা চিন্তাদর্শে তার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাইতো রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শরীরের

ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নিম্নে শ্রমিকের অধিকার প্রসঙ্গে ইসলামের রূপরেখা সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো:

🔸উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার

শ্রমের বিনিময়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাওয়া একজন শ্রমিকের অধিকার। ইসলামী বিধানে শ্রমিক, চাষি এবং অন্যান্য শ্রমজীবীকে কেউ বিনা পারিশ্রমিক খাটাতে পারে না। ইসলামের নির্দেশনা অনুসারে শ্রমিকের কাজের ফল বা মজুরি কিংবা পারিশ্রমিক যথাযথ দেওয়া এবং কোনোরকম জুলুম-অন্যায়, নিপীড়ন, শোষণ করা উচিত নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, 'প্রত্যেকের মর্যাদা তার কাজ অনুযায়ী। এটা এজন্য যে, আল্লাহ প্রত্যেকের কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দেবেন এবং তাদের প্রতি অবিচার করা হবে না।' [সূরা আহকাফ: ১৯]

অনেক সময় শ্রমিকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মালিকগণ উপযুক্ত মজুরি প্রদান না করে ইচ্ছামতো মজুরি দেন এবং শ্রমিকদের বঞ্চিত করেন ও ঠকান। আর শ্রমিকগণ নীরবে তা সহ্য করে থাকে। এ ধরনের কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেউ যদি শ্রমিকের মজুরি না দেয় অথবা দিতে গড়িমসি করে, তার বিষয়ে বলতে গিয়ে আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'আল্লাহ তাআলা বলেন, "কেয়ামত দিবসে আমি তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো। (১) যে ব্যক্তি আমার নামে শপথ করে কিছু দেওয়ার কথা বলে, তারপর তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। (২) যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন বা মুক্ত লোককে ধরে বিক্রয় করে তার মূল্য ভোগ করে। (৩) যে ব্যক্তি কোনো মজুরকে নিয়োগের পর তার থেকে পুরো কাজ আদায় করেও তার পাওনা পরিশোধ করে না।' [সহীহ বুখারী]

🔸পারিশ্রমিক পূর্বেই নির্ধারণ করার অধিকার
ইসলামের বিধান অনুসারে মালিকের কর্তব্য হচ্ছে- শ্রমিক নিয়োগের আগে অবশ্যই তার মজুরি নির্ধারণ করে দিতে হবে। আবু সাঈদ খুদরী রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিককে কাজে লাগাবে, সে যেন তার পারিশ্রমিক নির্ধারণ করে কাজে লাগায়।' [সহীহ বুখারী]

🔸বিলম্ব ব্যতিরেকে পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার

শ্রমিককে পরিশ্রম শেষে বা কাজ সম্পাদন করামাত্রই অবিলম্বে তার মজুরি দেওয়া বা প্রাপ্য পারিশ্রমিক প্রদান করা মালিকের সর্বপ্রধান দায়িত্ব। আবদুল্লাহ বিন উমর রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।' ইবনে মাজাহ]

🔸সামর্থ্যের বাইরে কাজ না করার অধিকার

শ্রমিকের ইসলাম স্বীকৃত একটি অধিকার হলো- মালিকপক্ষ থেকে তাকে এমন কাজ দেওয়া যাবে না, যা তার সাধ্য ও সামর্থ্যের বাইরে। যদি মালিকপক্ষ এমন কাজ দেয়, যা তার শর্তের আওতায় নয় কিংবা শারীরিক ও মানসিকভাবে মেনে নেওয়ার

মতো নয় কিংবা যে কাজটি চাপিয়ে দিলে ভবিষ্যতে তার শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে; তবে শ্রমিকের সে কাজটি না করে প্রত্যাখ্যান করার অধিকার রয়েছে। আল্লাহ তাআলা সে কথা এভাবে বলেন, 'আল্লাহ কোনো ব্যক্তি/নফসকে তার সাধ্যের বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না।' [সূরা বাকারা: ২৮৬]

🔸ধর্ম-কর্ম পালন করার অধিকার

ইসলামের বিধান অনুসারে শ্রমিক সর্বাবস্থায় স্বীয় ধর্ম-কর্ম পালন করার অধিকার সংরক্ষণ করবে। মালিকের পক্ষ থেকে শ্রমিককে মৌলিক ধর্ম-কর্ম পালন করার প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া কর্তব্য এবং এ ব্যাপারে কোনো ধরনের বাধা প্রদান করা যাবে না। যদি কোনো মালিক তার প্রতিষ্ঠানে ধর্ম-কর্ম পালন করার সুযোগ না দেয় কিংবা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে; তবে আল্লাহর ভাষায় সে চরম ভ্রষ্টতার মধ্যে নিমজ্জিত থাকবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, 'যারা পার্থিব জীবনকে ভালোবাসে এবং আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় ও তাতে বক্রতা সৃষ্টি করে, তারা চরম ভ্রষ্টতার মধ্যে নিপতিত।' [সূরা ইবরাহীম: ৩]

🔸লভ্যাংশের ভিত্তিতে অংশীদারিত্ব লাভের অধিকার

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিকদের লাভের মধ্যে অংশীদার হওয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, 'সম্পদ যেন শুধু ধনী লোকদের মধ্যে আবর্তন না করে।' [সূরা হাশর। ৭] শ্রমিকদেরকে উৎপাদন মুনাফায় শরীক রাখা হলে শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। শ্রমিকরা এই মনে করে অধিকতর বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করবে- এই কারখানায় যে মুনাফা হবে, তারা নিজেরাও তার অংশীদার। পাশাপাশি মালিকরাও বুঝতে পারবে- শ্রমিকদেরকে অংশীদার করার ফলে স্বাভাবিকভাবে অনেক ঝামেলা থেকেই মুক্ত হয়ে গেছে তারা।

🔸অবকাশ বা ছুটি পাওয়ার অধিকার

শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য বিশ্রাম, আপনজনদের সাথে একত্রে থাকা ও সামাজিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ করার জন্য সাপ্তাহিক ও বার্ষিক ছুটি প্রয়োজন। বিশ্রামহীনভাবে বা ছুটি ছাড়া একটানা কাজ করতে শ্রমিককে বাধ্য করানো যাবে না। একসঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কাজ করার পর কিংবা নিরবচ্ছিন্ন কয়েকদিন কাজ করলে তাকে ছুটি বা অবসর দিতে হবে। আরাম ও বিশ্রামের সুযোগ করে দিতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, 'আল্লাহ তোমাদের প্রতি সহজতা ও নম্রতা আরোপ করতে চান, কঠোরতা ও কঠিনতা আরোপ করতে ইচ্ছুক নন।' [সূরা বাকারা: ১৮৫]

🔸কাজের সময় ও ধরন জানার অধিকার

মালিক একজন শ্রমিকের দ্বারা কী ধরনের কাজ নেবে এবং কত ঘণ্টা কাজ করতে হবে, তা উভয়পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা দরকার। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, 'কোন কাজটি আল্লাহর কাছে পছন্দনীয়?' তিনি উত্তরে বলেছিলেন, 'নিয়মিত কাজ করা, যদিও তা সামান্য হয়।' তিনি আরও বলেছিলেন, 'তোমরা যে পরিমাণ কাজ অনায়াসে করতে পারো, সে পরিমাণ কাজেরই আয়োজন করবে।' [সহীহ বুখারী] রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম

বলেছেন, 'কাজের প্রকৃতি ও পরিমাণ না জানিয়ে কাউকে কাজে নিয়োগ করা যাবে না।'

🔸সমান কাজের সমান মজুরি পাওয়ার অধিকার

সব মানুষের মেধা ও দক্ষতা সমান নয়। এ কারণে উৎপাদন ক্ষমতাও সমান নয় সবার। আবার বিভিন্ন পরিমাণ উৎপাদনের জন্য সমান পারিশ্রমিক প্রদান যুক্তিসংগত নয়। সমান কাজের জন্য সমান পারিশ্রমিক প্রদানের নীতিমালা গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য। প্রত্যেকের কর্মানুযায়ী তার মর্যাদা নির্ধারিত হয়। কুরআনুল কারীমে আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে, 'প্রত্যেকের মর্যাদা তার কর্মানুযায়ী। এটা এ জন্য যে, আল্লাহ প্রত্যেকের কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দেবেন এবং তাদের প্রতি অবিচার করা হবে না।' [সূরা আহক্বাফ: ১৯।

🔸দাবি-দাওয়া পেশের অধিকার

ইসলাম মূলত এমনই এক পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়, যেখানে সবারই অধিকার সংরক্ষিত থাকে। চাওয়ার আগেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রত্যেকের অধিকার আদায় করে দিতে সবাই উদ্বুদ্ধ থাকে, কোনো দাবি পেশের দরকারও যেন না পড়ে। এরপরও যদি কারও অধিকার আদায় না হয়, তবে ন্যায়-ইনসাফের ভিত্তিতে প্রতিকার চাইতে পারবে সে। কোর্টে মামলা দায়ের করতে পারবে।

🔸উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিকার

নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মালিকদেরকে উৎসাহিত করতে যেয়ে ইরশাদ করেছেন, 'যাদের মধ্যে তিনটি গুণ আছে, তাদের মৃত্যু অত্যন্ত সহজ হবে এবং তাদেরকে আল্লাহ পাক জান্নাত দেবেন। সে তিনটির মধ্যে একটি হলো- অধীনদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার এবং তাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করা।' রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, 'তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই, যে অধীনদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে।' [হায়ছামী]

◉ইসলামের দৃষ্টিতে মালিকের প্রতি শ্রমিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য

ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য হলো এক সামঞ্জস্যপূর্ণ পৃথিবী গঠন করা, যেখানে সবাই নিজ নিজ ন্যায়ানুগ অধিকার সংরক্ষিত রেখে নিরাপদে তা ভোগ করতে পারে। ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনাদর্শ হিসেবে যেভাবে শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকারের বিষয়ে মালিকদেরকে অনেক প্রকার দায়িত্ব ও বিধি-নিষেধের অধীন রেখেছে, শ্রমিকদের ওপরও মালিকের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য বিষয়ে আবশ্যক ন্যায়নীতি আরোপ করেছে। ইসলাম শ্রমিকদেরকে লাগামহীন হওয়ার সুযোগ

দেয়নি। কেননা সম্পর্কের উন্নয়ন কখনও একতরফাভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, উভয়েরই সদিচ্ছার প্রয়োজন হয়। নিম্নে মালিকের প্রতি শ্রমিকের যে দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে তা উল্লেখ করা হলো:

◉অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা

একজন শ্রমিক বা কর্মচারী যখন ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করে তার পারিশ্রমিক গ্রহণ করবে, তখনই কেবল তা হালাল বা বৈধ উপার্জন হিসেবে বিবেচিত হবে। ইবনে উমর রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

'নিঃসন্দেহে কোনো গোলাম যখন তার মনিবের কল্যাণকামী হয় ও আল্লাহর বন্দেগি করে, তখন তার দ্বিগুণ সওয়াব অর্জিত হয়।'

[সহীহ বুখারী]

◉নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে সম্পাদনা করা

শ্রমিককে চুক্তি মোতাবেক মালিকের প্রদত্ত কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে সম্পাদন করতে হবে এবং মালিকের সম্পদ সংরক্ষণে যত্নবান হতে হবে। কারণ মালিক যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে শ্রমিকের পারিশ্রমিক সে পরিশোধ করবে কী করে? রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, 'আল্লাহ ওই শ্রমিককে ভালোবাসেন, যে সুন্দরভাবে কার্য সমাধা করে।' নবীজি আরও বলেন, 'তিন শ্রেণির লোকের দ্বিগুণ সওয়াব প্রদান করা হবে। তাদের মধ্যে এক শ্রেণি হলো ওই শ্রমিক, যে নিজের মালিকের হক আদায় করে এবং আল্লাহর হকও আদায় করে।' [মিশকাত]

◉আমানতদারির সাথে দায়িত্ব পালন করা

শ্রমিকের দায়িত্ব হলো মালিক কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব আমানতদারিতার সাথে পালন করা। তাতে কোনোভাবে খেয়ানত না করা। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিটি দায়িত্ব আমানতদারির সাথে পালন করা ফরজ। খেয়ানত করা হারাম। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন, 'সর্বোত্তম শ্রমিক সেই-ই, যে শক্তিশালী ও আমানতদার (দায়িত্বশীল) হয়।' [সূরা কাসাস ২৬]

◉সম্পদ চুরি না করা

মালিকের পক্ষ থেকে ন্যায়সংগত পারিশ্রমিক দেওয়ার পরও যদি শ্রমিক মালিকের সম্পদ চুরি করে, তা হবে অত্যধিক গর্হিত কাজ। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, 'যাকে আমরা কোনো দায়িত্ব প্রদান করেছি (কর্মচারী নিয়োগ করেছি) আর তাকে যথাযথ পারিশ্রমিক দিয়েছি; অতঃপর সে তার প্রাপ্য অধিকারের বাইরে কিছু গ্রহণ করলে তা হবে চুরি পর্যায়ের।'

◉কাজে গাফিলতি না করা

যে কাজ যেভাবে করা উচিত, সে কাজ ঠিক তেমনিভাবে আদায় করা শ্রমিকের জন্য অপরিহার্য। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'যখন কোনো বান্দা কাজ করে, তখন আল্লাহ চান- সে তার কাজে "এতকান" পয়দা করুক। অর্থাৎ যা যেভাবে করা দরকার, ঠিক সেইভাবে তাকে সম্পাদন করতে হবে।' হায়ছামী। নবীজি আরও বলেছেন, 'শ্রমিক তার মালিকের সম্পদের সংরক্ষক এবং সে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।'

◉কাজকে নিজের মনে করে সম্পাদন করা

কাজে নিয়োগ পাওয়ার পর শ্রমিক কাজকে নিজের মনে করে সম্পন্ন করবে। ইসলাম একজন শ্রমিককে এই নির্দেশনা প্রদান করে- মালিকের যে কাজের দায়িত্ব সে তার নিজের পছন্দ অনুযায়ী গ্রহণ করে নিয়েছে, তা তখন তার নিজের কাজ হিসেবে গণ্য হয়ে পড়েছে।

◉সৎকর্মশীল ও দায়িত্ববান হওয়া

সৎকর্মশীল একজন শ্রমিক যে আল্লাহ এবং মালিকের হক আদায় করতে থাকে তথা তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে, সে ইসলামের দৃষ্টিতে দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী হবে; এমনকি তা মালিক থেকেও বেশি। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'যে অধীনস্থ খাদেম আল্লাহ এবং তার মালিকের অনুগত থাকে, তাকে মালিকের সত্তর বৎসর পূর্বেই বেহেশতে প্রবেশ করানো হবে। মালিক তখন জিজ্ঞেস করবে, "আল্লাহ! এ তো আমারই একজন অনুগত খাদেম ছিল, তবুও এর এত মর্যাদা কেন?" আল্লাহ পাক বলবেন, "আমি তার কাজের প্রতিফল দিয়েছি। আর তোমাকেও তোমার কাজের প্রতিদান দিয়েছি।' [তাবরানী, হায়ছামী।

◉আখেরাতের সফলতার জন্য কাজ করা

একজন শ্রমিক তার শ্রমের মাধ্যমে যে অর্থ উপার্জন করবে, তা যেন হালাল হয় এবং এর বিনিময়ে সে যেন পরকালীন সফলতা লাভে ধন্য হয়; তার প্রতি লক্ষ রাখবে। শুধু পেট চালাবার নিমিত্তে সে কাজ করবে না, সেবার মানসিকতা নিয়ে পরম আগ্রহ ও আনন্দের সাথে কাজটি সম্পন্ন করাই হবে শ্রমিকের নৈতিক দায়িত্ব।

◉উপসংহার
ইসলাম মূলত এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়, যেখানে শ্রমিক-মালিক সবার অধিকার সংরক্ষিত থাকবে এবং চাওয়ার আগেই প্রত্যেকের অধিকার আদায় করে দিতে সবাই উদ্বুদ্ধ হবে। এতে উভয়ের মধ্যে সুমধুর সম্পর্ক বিরাজ করবে। ইসলাম চায় এমন এক সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে, শ্রমিক ও মালিকের সৌহার্দমূলক পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে এমন এক বিধান প্রচলন করতে; যেখানে থাকবে না শোষণ, থাকবে না অত্যাচার, থাকবে না নিপীড়ন, সর্বোপরি থাকবে না দুর্বলকে পিষে খতম করার কোনো জঘন্য প্রবণতা। এ ছাড়া ইসলাম মালিককে সহনশীল, হৃদয়বান এবং সহানুভূতি সম্পন্ন হতে শিক্ষা দেয়।

মালিক নিজের মনের মধ্যে শ্রমিককে কোনো প্রকার শোষণের অভিপ্রায়ও রাখতে পারে না, স্বাস্থ্য হানিকর ও তার সাধ্যাতীত কোনো কাজে তাকে নির্দয়ভাবে নিযুক্ত করতে পারে না। মালিক সমব্যথী হয়ে শ্রমিকের কল্যাণ সাধনে সচেষ্ট থাকবে, আনন্দে সঙ্গী হবে, তাকে আত্মীয়তার স্নিগ্ধ পরিবেশে রাখবে, সর্বোপরি একজন শ্রমিককে সে নিজের সহোদরের মর্যাদায় রাখবে; যার চেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আর কিছুই হতে পারে না। কাজেই শ্রমিক-মালিক উভয়পক্ষ যদি ইসলামের প্রদর্শিত নীতিমালা অনুসরণ করে; তাহলে একদিকে শ্রমিকদেরকে দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে হবে না, অন্যদিকে মালিকরাও শ্রমিকদের শোষণ করার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসবে। উভয়ের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং একে অপরের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। "

সাবেক শিবির সভাপতির এই রুপরেখা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রসংসায় ভাসছে।
অনেকেই এটা শেয়ার দিয়ে রাষ্ট্রে তা বাস্তবায়নের অনুরোধ জানাচ্ছেন বাংলাদেশ সরকারের কাছে।  সম্প্রতি বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবিরের ভেরিফাইড পেজ থেকে এই রুপরেখা পোস্ট করা হয়েছে।