নীলফামারীর সৈয়দপুরে রেলওয়ে কারখানায় তালিকাভুক্ত ৭৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থাকলেও গত ১৭ বছর ধরে বেশিরভাগ কাজই পাচ্ছে গুটিকয়েক ঠিকাদার। এই সিন্ডিকেট ইতিমধ্যে প্রায় ৫৫০ কোটি টাকার কাজ সম্পন্ন করেছে এবং বর্তমানে আরও দেড়শ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মূল সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের ভাগিনা ও ভাতিজা, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা এবং রেলওয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার আত্মীয়দের। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরেও তাদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে সৈয়দপুর রেলওয়ের সব কাজ। রেলওয়ে সূত্র জানায়, সৈয়দপুরে রেলওয়ের কাজ সাধারণত উন্মুক্ত দরপত্র এবং লোকাল টেন্ডার মেথড (এলটিএম) এই দুই পদ্ধতিতে করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, ৩৫ কোটি টাকার বেশি উন্নয়ন কাজ এবং ১৫ কোটি টাকার বেশি রক্ষণাবেক্ষণ কাজ উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে হওয়ার কথা। ১৫ কোটি টাকার কম হলে এলটিএম পদ্ধতিতে করা হয়। 'পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (পিপি) আইন, ২০০৬' এবং 'পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮' অনুযায়ী সরকারি অর্থে পণ্য, কার্য ও সেবা ক্রয়ে স্বচ্ছতা ও অবাধ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও সৈয়দপুরে রেলওয়ের ছোট-বড় প্রায় সব কাজই গুটিকয়েক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যাচ্ছে। সৈয়দপুরের অন্তত ১২টি স্থানীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ মোট ৭৩টি তালিকাভুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও গত কয়েক বছরে প্রায় ৫৫০ কোটি টাকার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রেলওয়ে কারখানার আধুনিকায়ন, সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন উঁচু করা ও প্ল্যাটফর্মের শেড পরিবর্তন, সৈয়দপুর-চিলাহাটি রেলপথ সংস্কার এবং চিলাহাটি ও ডোমার রেলস্টেশন আধুনিকায়নের মতো বড় প্রকল্প। বর্তমানে রেলওয়ে বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রের ভেতরে বিশ্বাস কনস্ট্রাকশনের সেডে বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষ উপলক্ষে ১০০ কোটি টাকার ব্রডগেজ রেলকোচ মেরামত এবং রেলওয়ে কারখানার ভেতরে যন্ত্রাংশ (কাঁচামাল) সরবরাহের কয়েক কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। সূত্র আরও জানায়, এসব কাজ মূলত পেয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের রাজশাহী মহানগর কমিটির নেতা আফসার বিশ্বাসের মালিকানাধীন এরিয়ান বিল্ডার্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিশ্বাস কন্সট্রাকশন নামের দুটি প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও আওয়ামী লীগের সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের ভাগিনা এপোলো ও ভাতিজা সাজু এবং রেলওয়ের এক বড় কর্মকর্তার আত্মীয়ও এই সিন্ডিকেটের অংশ। গত কয়েক বছরে তাদের অন্তত ৮০ কোটি টাকার কাজ বিনা দরপত্রে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে, গত বছর দরপত্র কারসাজির মাধ্যমে প্রায় ২০ কোটি টাকার কাজের অর্ধেকের বেশিই মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৮ কোটি টাকার কাজ পায় 'ডিসেন্ট' নামে আওয়ামী লীগের এক লোকের প্রতিষ্ঠান, আর ৪ কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয় গাইবান্ধার সাবেক এমপির চাচাতো ভাই শাহীনকে। অভিযোগ রয়েছে, তারা কোনো মালামাল সরবরাহ না করেই সব বিল তুলে নেয়। বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়লে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের একজন নিম্ন শ্রেণির কর্মচারীর ওপর দোষ চাপিয়ে তাকে বদলি করে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভুক্তভোগী ঠিকাদার ও রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানান, কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে উল্লেখিত ঠিকাদারদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় রেলওয়ের সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা কাজ পাওয়ার পর কেউ কেউ ৫ শতাংশ কমিশনে তৃতীয় পক্ষের কাছে চড়া মূল্যে বিক্রি করে দিচ্ছে, যার ফলে পেশাদার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই সিন্ডিকেট যখন কাজের চাহিদা কিংবা নিলাম সক্ষমতা হারায়, কেবল তখনই ১০ শতাংশের মতো কাজ পায় প্রকৃত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এভাবে স্থানীয় রেলওয়ের সিংহভাগ কাজই পাচ্ছে এই সিন্ডিকেট। এসব অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে বিশ্বাস কনস্ট্রাকশনের এমডি আফসার বিশ্বাসসহ উল্লেখিত অন্যান্য ঠিকাদারদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমনকি মোবাইল ফোনেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে হয়েছে। অভিযুক্ত ঊর্ধ্বতন রেলওয়ে কর্মকর্তারাও ফোন রিসিভ না করায় তাদের মতামত জানা সম্ভব হয়নি। রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়ন কারখানা শাখার সাধারণ সম্পাদক শেখ রোবায়েতুর রহমান বলেন, অর্থের বিনিময়ে ও স্থানীয় কয়েকজনের সুপারিশে ঘুরেফিরে একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হচ্ছে। ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো রেলওয়ের কাছ থেকে স্ক্র্যাপ মালামাল (অচল যন্ত্রাংশ) হিসেবে স্বল্প মূল্যে কিনে স্থানীয়ভাবে মেরামত করে রং করে বেশি দামে আবারও রেলের কাছেই বিক্রি করছে। তিনি আরও বলেন, ২০১৭ সালে ১৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে রেলওয়ে কারখানা আধুনিকায়নের কাজ করা হয়। আধুনিকায়ন কাজের আওতায় কারখানার ২৭টি সপের (উপ-কারখানা) শেডের পুরাতন টিন পরিবর্তন করে নতুন টিন লাগানো হয়। কিন্তু শেডে নিম্নমানের টিন ব্যবহার করায় মাত্র কয়েক বছর না যেতেই বৃষ্টিতে সেই টিন চুইয়ে পানি পড়ছে সপগুলোতে। পাশাপাশি নষ্ট হয়ে গেছে নতুন স্থাপিত অনেক মেশিন। অথচ ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ওই টিন ও মেশিনগুলো আরও ২০-২৫ বছর অনায়াসে যেত। এর জন্য তিনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করেন। বাংলাদেশ রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগ (বিআরইএল) সৈয়দপুর কারখানা শাখার সম্পাদক খায়রুল বাশার বলেন, বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগের লোকেরা রেলকে ধ্বংস করেছে। উন্নয়নের নামে লুটপাট করেছে। সাবেক রেলমন্ত্রীর স্ত্রীসহ ভাতিজা, ভাগিনা ও অন্য আত্মীয়-স্বজনরা রেলকে পৈত্রিক সম্পত্তির মতো ভোগ করেছে। তার লোকেরাই সব ঠিকাদারি বাগিয়ে নিয়ে সরকারি অর্থ তছরূপ করেছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগের নেতারা সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছেন। এ বিষয়ে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) শাহ সুফি নুর মোহাম্মদ বলেন, তার এ কর্মস্থলে আসা খুব বেশিদিন হয়নি। তাই আগের কাজগুলো সম্পর্কে তার জানা নেই। তবে তিনি জানান, রেলওয়ের যেসব কাজ ঠিকাদারের মাধ্যমে করা হয়, সেগুলোর স্থানীয়ভাবে দরপত্র আহ্বানের সুযোগ নেই। কাজগুলোর দরপত্র সাধারণত ঢাকা ও রাজশাহী থেকে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে হয়ে থাকে। এই অভিযোগগুলো রেলওয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তৈরি করেছে। এই বিষয়ে আপনার আর কিছু জানার আছে কি?