ছয় বছরের ফুটফুটে শিশু সৌরভ। বাড়ির পাশে এক শিক্ষিকার ঘরে প্রাইভেট পড়তে যায়

ছয় বছরের ফুটফুটে শিশু সৌরভ। বাড়ির পাশে এক শিক্ষিকার ঘরে প্রাইভেট পড়তে যায়। তারপর সে আর বাড়ি ফিরেনি। পরিবারের লোকজন অনেক খোঁজাখুঁজির প্রায় তিন ঘণ্টা পর একই গ্রামের বনর চৌধুরী নামে এক ব্যক্তির গোয়ালঘর থেকে শিশুটির রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে। নিষ্পাপ এই শিশুটির শরীরে ধারালো অস্ত্রের একাধিক আঘাতের চিহ্ন দেখতে পায় স্থানীয়রা।

গত সোমবার (১৬ জুন) সকাল ৬টা ২০ মিনিট থেকে ৮টার মধ্যে এ চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটে নেত্রকোনার মদন উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের দেওসহিলা গ্রামে। 

ঘটনার পর থেকেই যেন নির্বাক হয়ে গেছেন গ্রামের লোকজন। এ ঘটনায় গ্রামবাসী কেউ-ই মুখ খুলছেন না। তবে এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে গ্রামটির সর্বস্তরের লোকজনের মধ্যে ভেতরে ভেতরে চলছে নানা রকম জল্পনা কল্পনা। গ্রামের লোকজনের একটাই দাবি, নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।

এদিকে শিশু সৌরভ হত্যার ঘটনায় একই গ্রামের প্রতিপক্ষের মো. জিয়া (৪৫), সম্রাট মিয়া (৪২), লালন মিয়া (৫৩), নূপুর মিয়া (৩৫), বাকী মিয়া (২৮), মো. সালমান (১৯) ও মো. হোসাইন (২০) সহ ৭ জনের নামোল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরো ৫-৬ জনকে আসামী করে স্থানীয় মদন থানায় একটি হত্যা মামলা করেন শিশুটির বাবা সবু উল্লাহ। 

এর আগে, ঘটনার দিনই খবর পেয়ে পুলিশ শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করে এবং একই গ্রামের অপু, এফজি, লালন মিয়া, নূপুর মিয়া, জয় ও মুদি দোকানী জাহাঙ্গীর চৌধুরী নামে ৬ জনকে আটক করে। পরে ওইদিন রাতেই মামলা দায়ের হলে এজাহার নামীয় লালন মিয়া ও নূপুর মিয়াকে রেখে অন্য ৪ জনকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। 

তবে তাদের ছাড়াতে পুলিশের সাথে মোটা অংকের টাকার লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ করেন শিশু সৌরভের বাবা ও মামলার বাদী সবু উল্লাহ। তিনি বলেন, যদি ওরা নিরপরাধই হয়ে থাকে, তাহলে ওদেরকে টাকার বিনিময়ে ছাড়া হল কেন? এমন প্রশ্ন গ্রামের অনেকেরই। 

মামলার দায়েরের পর থেকে আসামীপক্ষের সকল পুরুষ লোকজন পলাতক রয়েছেন। বাড়িতে আছে শুধু নারী ও শিশুরা। তাদের মধ্যে মামলার প্রধান আসামী মো. জিয়ার স্ত্রী সীমা আক্তার, লালন মিয়ার স্ত্রী মেরিনা আক্তার, সম্রাট মিয়ার স্ত্রী রিমা আক্তার ও নূপুর মিয়ার স্ত্রী তানিয়া আক্তার জানান, শত্রুতাবশত তাদেরকে আসামী করা হয়েছে। এ ঘটনার সাথে এজাহার নামীয় আসামীরা কেউ-ই জড়িত না। তারাও প্রকৃত অপরাধীদের  খুঁজে বের করে অবিলম্বে আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানান।

স্থানীয়রা জানান, সবু উল্লার ভাই নিক্সন মিয়া পা কেটে ফেললে তাকে চিকিৎসার জন্য নূপুর মিয়ার অটোরিকশায় করে নিয়ে যেতে বলেন। তখন নূপুর মিয়া অসম্মতি জানালে তাদের দুপক্ষের লোকজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এরই জেরে শিশু সৌরভকে প্রতিপক্ষের লোকজন হত্যা করে লাশ বনর চৌধুরীর গোয়ালঘরে ফেলে রেখে যায়- এমন অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু ঘটনার ১৩ দিন পেরিয়ে গেলেও হত্যা রহস্য উদঘাটন করতে না পারায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে মামলার বাদী-বিবাদীসহ এলাকার লোকজনের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। 

সরজমিনে গেলে কথা হয় শিশু সৌরভের পরিবার, তার প্রাইভেট শিক্ষিকা, যে গোয়ালঘরে মরদেহটি পাওয়া যায়, তার মালিক ও স্থানীয় এক মুদি দোকানীসহ গ্রামের লোকজনের সাথে।

শিক্ষিকা পলাশী আক্তার বলেন, সৌরভ প্রতিদিনের মতো ওইদিনও সকাল ৬টার দিকে তার কাছে প্রাইভেট পড়তে আসে। কিছুক্ষণ পর সে দোকান থেকে মজা কিনে খাওয়ার কথা বলে শিক্ষিকার অনুমতি নিয়ে বইপত্র রেখে বের হয়ে যায়। পরে সে আর পড়তে না এলে শিক্ষিকা ভাবেন, হয়তো সৌরভ বাড়ি চলে গেছে। 

কিন্তু সাড়ে ৭টার দিকে সৌরভ বাড়ি না ফেরায় পরিবারের লোকজন তাকে খুঁজতে বের হয়। প্রথমেই তারা ছুটে যান শিক্ষিকা পলাশী আক্তারের কাছে। পরে তার কথা মতো তারা গ্রামের মুদি দোকানী জাহাঙ্গীর চৌধুরীর কাছে ছুটে যান। দোকানীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি শিশুটির পরিবারকে জানান, সকাল ৬টা ২০ মিনিটের দিকে সৌরভ তার দোকান থেকে ৬টি পাইলট সিগারেট কিনে নিয়ে চলে যায়। এর বেশি কিছুই জানাতে পারেননি তিনি। পরে তারা শিশুটিকে গ্রামের পুকুর, ডোবা, হাওরসহ পুরো গ্রামজুড়ে খুঁজতে শুরু করেন। কিন্তু কোথাও তার সন্ধান মিলেনি। একপর্যায়ে সকাল ৯টার দিকে জাহাঙ্গীরের মুদি দোকান সংলগ্ন বনর চৌধুরী তার গোয়ালঘর পরিস্কার করতে গেলে শিশু সৌরভের রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। তখন তিনি বিষয়টি অন্যদের জানালে মরদেহটি তার পরিবারের লোকজন গোয়ালঘর থেকে বাড়িতে নিয়ে যায়। ঘটনার খবর পেয়ে মদন থানার পুলিশ সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করে এবং মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করে। 

গোয়ালঘরের মালিক বনর চৌধুরী বলেন, আমি সকাল ৯টার দিকে গোয়ালঘর পরিস্কার করতে গিয়ে শিশুটিকে পড়ে থাকতে দেখি। প্রথমে মনে হয়েছিল, হয়তো সে এখানে এসে লুকিয়ে শুয়ে আছে। কিন্তু তার শরীরে ধাক্কা দিলে বুঝতে পারি সে জীবিত না। তারপর তার রক্তাক্ত মরদেহ দেখে ডাক-চিৎকার করলে প্রতিবেশিসহ শিশুটির পরিবারের লোকজন ছুটে এসে তাকে নিয়ে যায়। তবে কে বা কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে- এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান।

মুদি দোকানী জাহাঙ্গীর চৌধুরী বলেন, ঘটনার পর পুলিশ আমাকে থানায় নিয়ে গিয়েছিল। তারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমি যা জানি, তাই বলেছি। পরে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়।

এ বিষয়ে স্থানীয় মদন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাঈম মোহাম্মদ নাহিদ হাসান বলেন, বাদীর এজাহার নামীয় ৭ জন আসামীর মধ্যে দুজনকে এরইমধ্যে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। অন্য আসামীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। 

ঘটনার রহস্য উদঘাটনের বিষয়ে ওসি বলেন, রহস্য এখনো উদঘাটন হয়নি। তবে মামলাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। অচিরেই রহস্য বেরিয়ে আসবে বলে বিশ্বাস করি।

টাকার বিনিময়ে আটক ৪ জনকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে ওসি বলেন, ৬ জনকে আটক করার পর তাদের দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরইমধ্যে বাদী ৭ জনের নামোল্লেখ করে মামলা দিলে এজাহার নামীয় দুজনকে রেখে অন্য ৪ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। টাকা নেওয়ার বিষয়টি সত্য নয়। বাদী মামলা দায়েরের পর এখন যা ইচ্ছে তাই বলছেন।

এজাহার নামীয় আসামীদের পরিবারের লোকজন বলছেন, তারা নিরাপরাধ এবং ষড়যন্ত্রের শিকার- এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হবে না। যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের খুঁজে বের করতে পারলেই ঘটনা পরিস্কার হয়ে যাবে।