ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে খুলনা ছেড়ে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাকর্মী ও সাবেক এমপি-মন্ত্রীরা। মূলত ওইদিনই খুলনায় চূড়ান্তভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ঘণ্টা বেজে যায় বলে মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেতৃবৃন্দ।
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট খুলনায় যা ঘটেছিল
দিনটি ছিল রোববার। এদিন সকাল সাড়ে ১০টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা দাবিতে খুলনা মহানগরীর শিববাড়ি চত্বরে গণসমাবেশ পূর্ব ঘোষণা ছিল শিক্ষার্থীদের। বেলা পৌনে ১১টায় নগরীর শিববাড়ি মোড়ে খুলনায় সড়ক অবরোধ করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও জনতা। আটকে দেওয়া হয় মোড়ের চতুর্দিকের চলাচলের পথ। এ সময় তারা দফায় দফায় মিছিল ও বিক্ষোভ করে।
এ সময় আন্দোলনকারীদের স্লোগান ছিল ‘দফা এক দাবি এক শেখ হাসিনার পদত্যাগ’, দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত’, ‘আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার’, ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’। এছাড়া শিক্ষার্থীদের দাবির সমর্থনে দুপুর ১২টায় গোলকমনি শিশুপার্কে সামনে অবস্থান নেয় বৈষম্যবিরোধী সামাজিক ও সাস্কৃতিক ঐক্য। আর কেডি ঘোষ রোডের দলীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা।
অন্যদিকে নগরীর ৭টি স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচি করার ঘোষণা ছিল আওয়ামী লীগের। সে অনুযায়ী বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দলীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছিলেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। হঠাৎ কিছু আন্দোলনকারী পিকচার প্যালেস মোড় থেকে দলীয় কার্যালয়ের দিকে যেতে চাইলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের ধাওয়া করে। এ সময় কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দ শোনা যায়। দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইট পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পরে আন্দোলনকারীরা একত্রিত হয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া দিলে তারা পিছু হটে যায়। আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগ অফিসের দ্বিতীয় তলায় উঠে ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেয়।
এ সময় খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমডিএ বাবুল রানা এবং নগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ শাহাজালাল হোসেন সুজন, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পারভেজ হাওলাদার, কেসিসির কাউন্সিলর কনিকাসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের বেশ কিছু নেতাকর্মী আহত হয়। আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের পর তারা নৌপরিবহন মালিক গ্রুপের ভবনে ভাঙচুর চালায়। পরে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ নগর ভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে ভবনের কিছু কাঁচ ভেঙে যায়। এছাড়া জেলা পরিষদ অফিসের ভবনের সামনে আগুন দেওয়া হয়। খুলনার যমুনা টিভির প্রতিবেদকের গাড়িসহ ৪টি মোটরসাইকেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
দুপুরে বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ মিছিল নিয়ে খুলনা নগরীর শেরে বাংলা সড়কের ‘শেখ বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দীন ও শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েলের বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করে। বিকেল পৌনে ৩টার দিকে আগুন নিভে গেলে বেশ কিছু পুলিশ ও এপিবিএন এর সদস্যরা বাড়িতে আসেন। পরে যুবলীগের কিছু নেতাকর্মীকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বাড়ির সামনে আসে। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে সংসদ সদস্যের বাড়িতে আরেক দফা হামলা হয়।
দুপুর দেড়টায় আন্দোলনকারীদের একটি অংশ খুলনা প্রেস ক্লাবে ভাঙচুর চালায়। পরে বিকেল সাড়ে ৪টার দিতে আরেক দফা ভাংচুর করে প্রেস ক্লাবের ভেতরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া গগণবাবু রোডে সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের বাড়িতে ইটপাটকেল ছুড়ে মারে। এতে ভবনের কাঁচ ভেঙে যায়। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাড়ির সামনে অবস্থান নেন।
ঘটনার দিন সন্ধ্যায় দ্বিতীয় দফায় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেকের বাসভবনে হামলাকে কেন্দ্র করে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে উভয়পক্ষের ৩৫ জন আহত হয়।
অন্যদিকে খালিশপুরে অবস্থিত বিএনপির কেন্দ্রীয় ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যার পর নগরীর খালিশপুর থানা ও ১৫নং ওয়ার্ড বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। খালিশপুর নয়াবাটি মোড়ে অবস্থিত স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মাহমুদুল হাসান শিমুলের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও মালামাল লুটপাট করা হয়।
যা বলছেন আন্দোলনের নেতারা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনা মহানগর কমিটির সাবেক মুখপাত্র আয়মান আহাদ বলেন, ২ আগস্ট খুলনায় তীব্রতর আন্দোলনের সূচনা হয়। এদিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ ঘটে। পরে আর পুলিশ অ্যাকশনে যায়নি। ৪ আগস্ট সকাল থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রাজপথে নেমে আসে। ওইদিন সকালে শিববাড়ি মোড়ে আমাদের কর্মসূচি ছিল। সেখানে মানুষ জড়ো হয়। একপর্যায়ে শিববাড়ি জনতার ঢল নামে। আমাদের কর্মসূচিতে আসার সময় ছাত্র-জনতার ওপর আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে ছাত্রলীগ হামলা চালায়। পরে ছাত্র-জনতা সেটি রুখে দেয়। আমরা শিববাড়িতেই ছিলাম। সেখানে আর কেউ আসতে পারেনি। ওইদিনই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা খুলনা ছেড়ে যায়। এরপর আর তাদের দেখা যায়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক সাজিদুল ইসলাম বাপ্পি বলেন, ৩ আগস্ট এক দফা দাবির পর খুলনার আর ঘরে বসে থাকেনি। আর ৪ আগস্ট মানুষ দলে দলে রাজপথে নেমে এসেছিল। প্রকৃতপক্ষে খুলনা শহরটা গত ১৭ বছর ধরে আওয়ামী লীগের দোসররা লুটেপুটে খেয়েছে। এই শহরে একটি বাড়ি ছিল আজকে সেটা একটি ঘৃণা স্তম্ভে পরিণত হয়েছে। ‘শেখ বাড়ি’ খ্যাত সেই বাড়ি থেকে এই শহরের সকল প্রকার অন্যায়, অনিয়ম, অত্যাচার, অপকর্ম, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, লুটপাট সব কিছু কন্ট্রোল করা হতো।
তিনি বলেন, খুলনার মানুষের শেখ বাড়ির প্রতি এবং এই বাড়ির ঘনিষ্ঠ যে সমস্ত দোসররা আছে তাদের প্রতি বহুদিন ধরে রাগ, ক্ষোভ এবং ক্রোধ ছিল। এক দফা ঘোষণার সাথে যার বহিঃপ্রকাশ আমরা ৪ আগস্ট দেখতে পেয়েছি। এদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ দলে দলে রাজপথে নেমে এসেছিল। তাদের রাগ, ক্ষোভ এবং ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পেয়েছি। আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগের পেটুয়া বাহিনী অস্ত্র হাতে বেরিয়েছিল। তাদের অস্ত্রের মুখেও সাধারণ মানুষ ভয় পায়নি। তাদেরকে হঠিয়ে দিয়ে খুলনাকে দখল করেছিল। এটি আমাদের জীবনের এক অনন্য স্মৃতি হয়ে রয়েছে। মূলত ওই দিন খুলনায় চূড়ান্তভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ঘণ্টা বাজে।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে জুলাইয়ে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের কোটা সংস্কারের জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সরকারের দমন-নিপীড়নের মুখে তা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে পরিণত হয়। এক মাসের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। দাবি ওঠে সরকারের পদত্যাগের এক দফার। অবসান ঘটে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের অপশাসনের। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার এক দফা দাবির আন্দোলনের মুখে দেশ ত্যাগ করে পালাতে হয় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের।