এই গণঅভ্যুত্থানের কারণে ৫ই আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে এবং দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয়।একটা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে এই গনঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছিলো বাংলাদেশের সকল স্তরের মানুষ। যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না,কোনো হানাহানী থাকবে না।বাস্তবে এই প্রত্যাশার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তাই জানিয়েছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়টির লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদ জিসান বলেন,"আজ গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এই এক বছরে আমাদের প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি শূন্যের ঘরে। অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হলেও এখন পর্যন্ত একজন গণহত্যাকারীরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারেনি এই অথর্ব সরকার। হয়নি কোনো বিচার।বরং হয়েছে পুনর্বাসন। এবং অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী দলগুলোই এই পুনর্বাসন করাচ্ছে।
অসংখ্য আহত এখনো হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছে,অথচ তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সুচিকিৎসা পাওয়ার কথা ছিল।তারা তো তা পাচ্ছেই না বরং দেখতে পাচ্ছি এদের নিয়ে এই অথর্ব সরকারের যতটা না চিন্তা তার চেয়ে অনেক বেশি চিন্তা পতিতাদের অধিকার,এলজিবিটিকিউ অধিকার নিয়ে।
এছাড়াও বিগত এক বছরে গণঅভ্যুত্থানের দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের ফাটল ব্যতীত আমরা কিছুই দেখতে পাইনি।
পরিশেষে প্রাপ্তি হিসেবে যা প্রত্যাশা ছিল তার তেমনকিছুই পাইনি আমরা, প্রাপ্তি বলতে আজ দীর্ঘ একবছর পর পেতে যাচ্ছি আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেই জুলাই সনদ।এখন দেখার বিষয় এটা কতখানি কম্প্রোমাইজড।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী ও জুলাই যোদ্ধা ইফতেখার সায়েম বলেন, "গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল কোটা বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। তখন আমরা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করতাম। রাস্তায় প্লাকার্ড,ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তাতে লিখা ছিল "রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে। সাময়িক দুর্ভোগের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত"। প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। ইচ্ছা সব অনিয়ম অবিচার অল্প সময়ের মধ্যে বন্ধ করে ভালো কিছু দিয়ে তা প্রতিস্থাপন করবো,কিন্তু তা করতে পারিনি। গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী সিন্ডিকেট ভেঙে যায়। বাজারে,জনজীবনে শান্তি আসে। সম্ভবত ১৭ ই আগস্ট, ২০২৪ আমি ঢাকা মেডিকেলে যাই। রাস্তার পাশে একটা দোকান থেকে খিচুড়ি কিনে দাম জিজ্ঞেস করলে দোকানদার বলে ৩০ টাকা। অথচ একই জায়গা থেকে একই খিচুড়ি আমি ৫০ টাকা দিয়ে খেতাম গণঅভ্যুত্থানের আগে। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করি দাম এতো কম রাখছেন কেন? তিনি বলেন এখন আর ১০০০ টাকা চাঁদা দেয়া লাগে না কাউকে।
আজ তো আওয়ামী লীগ নেই। তবুও কেন দেশে খুন,ধর্ষণ,চাঁদাবাজি,টেন্ডারবাজি ইত্যাদি হচ্ছে? এখন আবারও জিনিসপত্রের দাম আবারও বেড়ে মানুষের নাগালের বাইরে গেল? কেন অনেক বিপ্লবীদের চরিত্রের নৈতিক স্থলন হলো?
গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ছিল দেশের পুরো কাঠামোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।মুজিববাদী সংবিধান সহ অনেক কিছুর শিকড়সমেত উগড়ে ফেলা হবে, বিচার হবে, সংস্কার হবে। কিন্তু এসব কিছুই আশানুরূপভাবে হচ্ছে না।
এই অভ্যুত্থানকে একটা বিপ্লবে রূপ না দিতে পারা আমাদের ব্যর্থতা। এই অভ্যুত্থানকে সফল বলা যেত, যদি আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে অপরাধীদের গ্রেফতার ও বিচার করতে পারতাম, যদি সাম্য ও মানবিক মর্যাদার প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের রাজধানীসহ অন্যান্য জায়গার পথে ঘুমানো নাগরিকদের জন্য ১০-২০ টা ভবন নির্মাণ করে দেয়া যেত, যদি হাসপাতালগুলোর ধারণ ক্ষমতা দ্বিগুণ-তিন গুণ করা যেত, যদি ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স থাকতো, যদি আহতদের উন্নত চিকিৎসা দেয়া হতো,যদি দেশে জঙ্গী নাটক বন্ধ হতো, যদি দেশে ইসলামোফোবিয়া বন্ধ হতো, যদি দেশটা হতো আস্থা ও বিশ্বাসে ভরপুর হতো।
দেশে এখনো জাতীয় রাজনীতির বদলে দলীয় ও অনৈক্যের রাজনীতি, ট্যাগিং ও মাইনাস করার রাজনীতি চলমান।
আজ আমরা চরম আস্থাহীনতায় ভুগছি। সন্দেহ হয় দেশটা ভারতের কোল থেকে নেমে পশ্চিমাদের কোলে উঠছে কিনা। এটাও সন্দেহ হয় যে দেশে আগামী নির্বাচনটাও সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ হবে কিনা।
আজ যদি বিপ্লবীদেরও অর্থ কেলেংকারিতে জড়িত দেখি, মনে হয় কেন করলাম এই ত্যাগ? যখন দেখি সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো গনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখন ভাবি কোন বেঈমানের হাতে গিয়ে পড়লাম?
এই জাতি আরেকটি গণবিপ্লবের অপেক্ষায়।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের আর এক শিক্ষার্থী সমাজবিজ্ঞান বিভাগের নাফিজ মোহাম্মদ মিকাইল বলেন,"গণঅভ্যুত্থানের শাব্দিক পরিভাষা যেখানে বুঝায় গণমানুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণে এক আমূল পরিবর্তনের পদযাত্রা বা নব দিগন্তের উন্মোচন, সেখানে জুলাই বিপ্লবের আজ একটি বছর অতিবাহিত হতে চললো কিন্তু গণমানুষের সেই সম্মিলিত সংস্কার কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি সহযোগিতা তুলনামুলকভাবে একদমই ফিকে।
যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সর্বস্তরের সর্বদলীয় ছাত্র-জনতা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছিলো, তাদের অধিকাংশই আজ ব্যক্তিস্বার্থ আর দলীয় স্বার্থ আদায়ের জন্য বিকিয়ে দিচ্ছে সেই স্পৃহা। এজন্যই আজকে বলতে গেলে আমরা বলে উঠি আমাদের প্রাপ্তির খাতা শূণ্য। আদতে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে অসহযোগিতা করার মাধ্যমে রাষ্ট্র বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অকেজো দাবি করে আমরা আমাদের যার যার দলকে আগামীর বাংলাদেশের আদর্শ সরকার হিসেবে দাবি করায় ব্যস্ত। দিনশেষে ঘরের শত্রু বিভীষণের ফলেই আমরা উল্লেখযোগ্য কিছু পাইনি।
ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী ও জুলাই যোদ্ধা মোঃবিপ্লব বলেন,"ফ্যাসিবাদের কোনো দল হয়না। আওয়ামীলীগ কালান্তরে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছে, তাদের স্থানে পোশাক বদলে আরেকদল যাতে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে না পারে—জুলাই পরবর্তী সময়ে আমরা সেই প্রত্যাশা রাখি। জনগণের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, শিক্ষার মানোন্নয়ন, রাজনীতি, অর্থনীতি, এবং সাংস্কৃতিকভাবে এক অগ্রসর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যা এই জনপদের মানুষের বহুকালের অপূর্ণ প্রত্যাশা।"
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ শাহিন বলেন,"তৎকালীন ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী দল আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদের শক্তিশালী শিকড় প্রোথিত হয়েছিল। এরপর তারা ক্ষমতায় এসে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর যে দুঃশাসন প্রতিষ্ঠার করেছিল তা ইতিহাসে বিরল। দেশপ্রেমিক ,চৌকষ সেনাবাহিনীর অফিসারদের হত্যা , বিরোধীদলের উপর পৈশাচিক নির্যাতন, মিথ্যা মামলা দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো ,গুম ,খুন,ধর্ষণ ও জালিয়াতি সহ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছিল এই আওয়ামী সরকার । ফ্যাসিস্ট শাসনের যাতাকলে অতিষ্ঠ হয়ে এদেশের মানুষ ধর্ম বর্ণ দলমত নির্বিশেষে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে ।অবশেষে ৫ ই আগষ্ট ২০২৪ ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন ঘটে। এদেশের মানুষ আন্দোলন করেছিল তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবার জন্য। ২৪ এর জুলাই আন্দোলন এর মধ্যে দিয়ে তারা চেয়েছিল এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়তে যেখানে মানুষ তার সকল ধরনের মৌলিক অধিকার ফিরে পাবে,ফিরে পাবে বাক স্বাধীনতা, এবং ভোটের অধিকার । এদেশের মানুষ চেয়েছিল যেন আওয়ামী ফ্যাসিস্ট এর সহযোগীদের প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনা হয় এবং তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হয়।সকল ধরনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের হাত থেকে মুক্তি দেয়া যায়। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে জুলাই গণঅভ্যু্থানের এক বছর পেরিয়ে গেলেও দৃশ্যমান কোন সংস্কার এখনো করতে পারে নি এই অভ্যুত্থানের সরকার।প্রশাসন যন্ত্র থেকে নিয়ে সরকারি সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানে ফ্যাসিস্ট লীগের দোসরদের পূনর্বাসন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ১৪০০ শহীদ ও ২০০০০ আহত ভাইদের রক্তের উপর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন বিষয় ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের সকল অংশীজনদের স্বীকৃত সনদ প্রদান কিন্ত সেটাও করতে ব্যর্থ হয়েছে এই সরকার । সবশেষে বলা যায় জনগণের বুক ভরা আকাঙ্ক্ষা প্রত্যাশার কাছে প্রাপ্তির পরিমাণ শূন্যই রয়ে গেছে।"