সম্প্রতি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে ঘটে গেছে একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা। যদিও এমন ঘটনা এই প্রথম ঘটেছে তা নয়।আগেও ঘটেছে।আর বরাবরই এ বিষয়টি আমাদের সুশীল সমাজ এড়িয়ে যান। আমিও এড়িয়ে যাই।অনেকবার ভেবেছি এ বিষয় নিয়ে লিখব,আবার অনেক কিছু ভেবেই লেখা হয়নি। শিশু রাহাত হত্যার খবরটি সামনে আসায় যেমন মর্মাহত হয়েছি তেমন আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে শংকিত হচ্ছি।রাহাত হত্যার ঘটনা বিবেককে নাড়া দিবে প্রতিটি বিবেকবান মানুষকেই।আমাদের সন্তান কোন পথে যাচ্ছে!তাদের ভবিষ্যৎ কি?পরিবার,সমাজ,রাস্ট্র কি পাবে তাদের কাছ থেকে? এমন হাজার প্রশ্ন ভিড় করছে মনে।১২-১৩ বছর বয়স হবে রাহাতের।পড়ত সপ্তম শ্রেণীতে।
চট্টগ্রামের সানোয়ারা ইসলাম বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে।ছেলেটির স্বপ্ন ছিল বড় ক্রিকেটার হবে।পড়াশোনাও ভালো ছিল।
খেলত ব্রাদার্স ইউনিয়নের জুনিয়র দলে, নেতৃত্ব দিত অনূর্ধ্ব-১১ ও ১২ দলের। এই বয়সী একটি মেধাবী ছাত্রের জীবনের সমাপ্তি হলো তাও আবার তারই সহপাঠী বন্ধুদের হাতে!যে চার জন তাকে খুন করেছে তাদের বয়সও ১৩-১৪ বছরের মধ্যে। ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে বসার মতো সামান্য একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে শুরু হয় বিরোধ।আর এই সামান্য বিষয়ের জন্য একটি শিশুর প্রাণ দিতে হলো? যে সহপাঠীদের সাথে দেখা হত রোজ সকালে। যে সহপাঠীদের সাথে কেটেছে অনেকটা সময়।যে সহপাঠীদের সাথে বলেছে মনের কথা,স্বপ্নের কথা। যে সহপাঠীদের বিশ্বাস করে তাদের সাথে গিয়েছিল টিফিন টাইমে।সেই সহপাঠীরা কিভাবে পারলো তাকে খুন করতে?যাদের চোখে থাকার কথা মায়া,ভালাবাসা,ভয়,স্বপ্ন।যাদের হাতে থাকার কথা কলম,পেন্সিল,বই।যেই কচি কচি আঙুল দিয়ে বইয়ের পাতা উল্টোনোর কথা,যেই হাত দিয়ে ফুল পাখি প্রজাপতি ধরার কথা, সেই হাত সেই চোখ সেই মনগুলো এখন খুনের মত পরিকল্পনায় যুক্ত।সেই হাতে তুলে নিচ্ছে অস্ত্র। সেই হাত রঞ্জিত করছে মানুষ খুনের রক্তে। ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। রাহাত খুন হয়েছে। খুনিরা বাকি জীবনে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে কি না সন্দেহ।এক সাথে পাঁচটি শিশুর জীবন শেষ হলো।তবে এর জন্য কি শুধু শিশুরা দ্বায়ী?পরিবার,সমাজ,রাস্ট্র কেউ কি এই দ্বায় এড়াতে পারে? পারে না। খুব বেশি দূরে নয়,নব্বই দশকে আমরা ফিরে যাই তখনও শিশুদের মধ্যে শিশু সুলভ মন খুঁজে পাওয়া যেতো।খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে এই অবক্ষয়ের পথ তৈরী হয়েছে। আমরা জানি শিশুদের প্রথম শিক্ষা পরিবার আর দ্বিতীয় শিক্ষা বিদ্যালয়।মা বাবার পরেই শিক্ষকের স্থান।কিন্তু শিক্ষকদের সেই সম্মানের জায়গা নষ্ট করার পিছনে আমাদের সমাজই দ্বায়ী।বিদ্যালয়ে বই পড়া হয়,সার্টিফিকেট অর্জিত হয় কিন্তু মানুষ শিক্ষিত হয় না।শিক্ষার হার বেড়েছে, বড় হওয়ার প্রতিযোগীতা বেড়েছে পক্ষান্তরে কমেছে মনুষ্যত্ব, বিবেক ।সামাজিক প্রভাব আর বাবার অর্থের মানদণ্ডে গড়ে তোলা হয় শিশুর মানসিকতা। শিশুরা শিশু বলে তাদের শাসন করা যাবে না,বা সমাজপতি,পুঁজিপতির সন্তান হলে ছাড় দেওয়া হবে এই মানসিকতার ফলেই আজ সমাজের এই পতন।এ বিষয়ে আমার একটি অভিজ্ঞতাও হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারী মাসে আমার ছেলের সাথে একটি ঘটনা ঘটে।বেনাপোল থানার ঘিবা গ্রামে।আমার ছেলে গ্রামের খোলা রাস্তা পেয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিল।বাড়ির অদূরে কিছু ১৩-১৪ বছর বয়সী ছেলে মাহফিলের জন্য চাঁদা তুলছিল।আর চাঁদা না দেওয়ায় আমার ছেলেকে চারজন ধরে মারধর করে এমনকি ঘাড় মটকে দেওয়ার চেষ্টা করে।এর প্রতিবাদ করাই আমার উপর হামলা করে ঐ শিশুগুলোর মধ্যে একজনের মা বাবা।বিষয়টি বেশ জটিল হয়।তখন আমি বেনাপোল থানায় অভিযোগ করি।সেখানে বিচারের ব্যবস্থা করা হয়।এর দ্বায়িত্বে ছিলেন বেনাপোল থানার একজন এস আই।শালিসি বক্তব্যের এক সময় এস আইয়ের কিছু কথায় বেশ হতাশ হই।আমার ছেলের বয়স ১২ বছর।তারা যখন প্রথম আমার ছেলের সাইকেলে লাথি মারে তখন আমি নিজে তাদের বুঝিয়েছি,আমার ছেলেকে না আটকাতে।ঘটনার আগের রাত একটায় আমার বড় ভাইকে দাফন করেছি,পরের দিন সকাল দশটার দিকে ঘটনা।মাত্র নয় ঘন্টা আগে ভাইকে কবরে রেখে এসে বাচ্চাদের সাথে জোরে কথা বলার শক্তিও আমার ছিল না।অথচ,ঐ পুলিশ কর্মকর্তা বা অন্য যারা বিজ্ঞজন ছিলেন তাদের কাছে আমার ছেলেকে মারার বিষয়টি খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছে। বিচারিক দ্বায়িত্বে থেকে এমন মনোভাব আমাকে আহত করেছে বেশ।তাছাড়া পুলিশ কর্মকর্তা বললেন,এখন যুগ এসেছে নিজের সম্মান বাঁচিয়ে চলতে হবে।এখনকার বাচ্চারা কথা শোনে না।ওরা বড়দের মানে না,তাই ওদের কিছু বলা আপনার ঠিক হয়নি।যদিও বিচারের সিদ্ধান্তে তারা আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে তবে পুলিশ কর্মকর্তার এমন দ্বায়িত্বহীন কথায় হতাশ হয়েছি।প্রথমত,আমার ছেলেও শিশু।আমার সন্তানের সাথে অন্যায় হলে মা হয়ে প্রতিবাদ করবই।না করলে আমার সন্তানের সাথে অন্যায় করা হত।আমার ছেলে কিন্তু প্রতিশোধ নিতে চায়নি।তাহলে সব শিশু এক নয় এটা বোঝা গেলো।এটা শিক্ষার বিষয়।আমার ছেলেকে মেরেছে তিনজন।একটি পরিবার ছাড়া বাকি দুজন শিশু আমার ছেলেকে স্যরি বলেছে নিজ থেকে।এখানেও পারিবারিক শিক্ষার বিষয় চলে আসে।প্রশ্নও আসে তাহলে আজ সমাজের এত অবক্ষয় কেনো? উত্তর হলো যারা এই শিশুদের অপরাধকে প্রশ্রয় দেয় তারাই মূলত এর জন্য দ্বায়ী।অপরাধ অপরাধই।যেহেতু তারা শিশুকে তাদেরকে শিশুর মতই শাসন করতে হবে বুঝাতে হবে।শিশু বলে অপরাধ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।শিশুদের অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়ার মানসিকতা থেকে শিশু অপরাধ বেড়েছে যার ফলশ্রুতিতে আজকের রাহাত খুন।খুনী তার সমবয়সী শিশুরা।শিশুর অপরাধকে অপরাধ ধরে তাকে শাসন করতে গেলে নিজের সম্মান থাকবে না ভাবা সুশিল সমাজের মস্তিষ্কে যে পচন ধরেছে সে পচনের বহিঃপ্রকাশ আজকের কিশোর গ্যাং।এই কিশোর গ্যাংরা যদি জানত,অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে তাহলে অন্যায় করতে ভয় পেতো।যদি শিশু রাহাতের খুনিরা শিশু অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখত তাহলে তারা খুন করার আগে একটু হলেও ভাবত।যারা খুনের পরিকল্পনা করে,যারা অস্ত্র হাতে নেয়,যারা চাঁদা না দেওয়ায় ঘাড় মটকে দিতে চায় তাদের শিশু ভাবাটাই বরং অপরাধ। যে সমাজে শিশুরা মা বাবার হাতে লাঠি দেখে ভয়ে পালায়,যে সমাজে শিশুরা শিক্ষকের হাতে বেত দেখেও সামনে গিয়ে হাত পেতে দেয় মাথা নিচু করে,যে সমাজে বড়দের সামনে কথা বলতে শিশুরা একবার ভেবে নেয় সেই সমাজের অবকাঠামো তৈরি এখন সময়ের দাবী।না হলে এই প্রজন্মকে ধ্বংস থেকে বাঁচানো সম্ভব না।যিনি নিজেকে সুশিল ভেবে নিজেকে দূরে রাখবেন তার সাথে যখন এমন ঘটনা হবে তখন কি করবেন?শিশু রাহাতের বাবা কি পারবেন চুপ থাকতে বা খুনিদের শিশু ভাবতে?পারবে না। সমস্যা এড়িয়ে নয় সমস্যা মোকাবেলা করেই সমাধান করতে হয়।আজকের শিশুরা আগামীর ভবিষ্যৎ। শিশুদেরকে শিশুদের মত পরিবেশ দিয়েই বড় করার মানসিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে শিশুদের ভালোর জন্যই।