জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) চলতি অর্থবছরের প্রথম ও ইন্টারিম সরকারের ১২তম সভায় ৮ হাজার ১৪৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয় সম্বলিত ১২টি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই সভায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে যে প্রকল্পগুলো অনুমোদিত হয়েছে, তার মধ্যে দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, শিক্ষা, শক্তি ও স্যানিটেশন খাত সংশ্লিষ্ট প্রকল্প রয়েছে।


অবশ্যই এসব প্রকল্প দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের প্রয়াস। তবে একটি প্রশ্ন এখন দিন দিন প্রবল হয়ে উঠছে—এই উন্নয়ন কতটুকু সমতাভিত্তিক? বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের দিকটি আবারও থেকে গেল কি না দেখা উচিত গভীরভাবে।

সাম্প্রতিক অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর বিশ্লেষণে দেখা যায়, এর একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে রাজধানী ঢাকা ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প যেমন ২ হাজার ৮৪০ কোটি টাকার বৃহৎ একটি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে, তেমনি রয়েছে কর্ণফুলী নদী, চট্টগ্রামের লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, ও মিরপুর সেনানিবাসসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ ও সম্প্রসারণ প্রকল্প।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এতসব উদ্যোগের মধ্যেও উত্তরবঙ্গের কোনো জেলা প্রকল্প অনুমোদনের তালিকায় স্থান পেল না। কেবল অনুমোদন না পাওয়াই নয়—এই সভায় যে ১৮টি পূর্ব-অনুমোদিত প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে, সেখানেও উত্তরবঙ্গ যেন অনুপস্থিত!

বিশেষ করে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদী দ্বারা ঘেরা অঞ্চলগুলোর (যেমন—কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, রংপুর) ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হাজার হাজার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দীর্ঘদিন ধরে চলমান। বারবার মানববন্ধন, স্মারকলিপি, সংবাদ প্রতিবেদন, সংসদে প্রশ্ন—সবকিছু করেও এই অঞ্চলের জন্য একটি টেকসই নদী ব্যবস্থাপনা বা নদীভাঙন প্রতিরোধ প্রকল্প যেন শুধুই প্রতিশ্রুতির কাগজে বন্দি!

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কথা বললে, উত্তরাঞ্চলের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) বারবার ‘ফার্স্ট প্রায়োরিটি’র আশ্বাস পেয়েছে—কিন্তু বাস্তবায়ন শূন্য! পুরো ১২টি একনেক বৈঠকে বেরোবি কেবল আশ্বাসই পেয়েছে, অর্থ বরাদ্দ নয়।

উত্তরবঙ্গ নিয়ে রাষ্ট্রীয় নীতিতে বারবার অবহেলা, দীর্ঘমেয়াদী অগ্রাধিকারের অভাব, এবং ‘ঢাকা-কেন্দ্রিক উন্নয়ন’ কেবল যে একটি অঞ্চলকে পিছিয়ে রাখছে তাই নয়, তা সমতা ও ন্যায়ের প্রশ্নেও বড় প্রশ্নচিহ্ন রেখে যাচ্ছে।

সরকারের প্রতি আমাদের জোরালো আহ্বান, উন্নয়নের এই প্রবাহ যেন সুষম হয়, শূন্যতা পূরণে উত্তরবঙ্গ যেন প্রকৃত প্রাপ্য পায়। নদীভাঙনের শিকার মানুষদের পুনর্বাসন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কৃষিভিত্তিক গবেষণা ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ ছাড়া উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন শুধু কল্পনায়ই থেকে যাবে।

উন্নয়ন শুধু ঘোষণায় নয়, তা হতে হবে বাস্তব প্রয়োগে—সব অঞ্চলের জন্য। অবহেলিত উত্তরবঙ্গ এখন শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, কার্যকর পদক্ষেপ চায়।