রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলায় দুই সাংবাদিকের ওপর নৃশংস হামলার ঘটনা শুধু দুইজন পেশাজীবী মানুষের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি দেশের মফস্বল সাংবাদিকতার চরম নিরাপত্তাহীনতার জ্বলন্ত প্রমাণ

রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলায় দুই সাংবাদিকের ওপর নৃশংস হামলার ঘটনা শুধু দুইজন পেশাজীবী মানুষের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি দেশের মফস্বল সাংবাদিকতার চরম নিরাপত্তাহীনতার জ্বলন্ত প্রমাণ। শনিবার (২৬ এপ্রিল) বিকালে উপজেলার পাঁচুবাড়ি এলাকায় ঘটে যাওয়া এ হামলা আবারও মনে করিয়ে দিল সত্য প্রকাশের মূল্য আজও জীবন দিয়ে দিতে হতে পারে।

দুর্গাপুর থেকে রাজশাহীতে ফেরার পথে সাংবাদিক শাহাবুদ্দিন ও ইসরাফিল ফুটবল খেলা দেখতে কিছুক্ষণ থেমেছিলেন পাঁচুবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে। তখনই ওঁত পেতে থাকা ২০-২৫ জনের একদল সন্ত্রাসী তাঁদের ঘিরে ধরে। সন্ত্রাসীদের মুখে একটাই প্রশ্ন ছিল—”সংবাদ প্রকাশ কেন করলি?” এরপর শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। সাংবাদিকদের ওপর চলতে থাকে পৈশাচিক হামলা। মাথায় লাঠির আঘাত, শরীরে লাথি-ঘুষি, এবং শেষে ক্যামেরা ও মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেওয়া—সবই ঘটে প্রকাশ্য দিবালোকে। তাঁদের টেনে হিঁচড়ে একটি নির্জন মাঠে নিয়ে গিয়ে আরও বীভৎস নির্যাতন চালানো হয়।

দৃশ্যটি এতটাই মর্মান্তিক ছিল যে, স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা তা সহ্য করতে না পেরে ছুটে যান উদ্ধার করতে। তাঁদের সাহসিকতায় শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকদের রক্ষা করা সম্ভব হয়। তবে হামলাকারীদের মধ্যে দুজন স্থানীয়দের হাতে আটক হলেও বাকিরা পালিয়ে যায়। বর্তমানে আহত সাংবাদিকরা রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দুজনেরই শারীরিক অবস্থা আশঙ্কামুক্ত নয় বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

হামলার মূল কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, সাংবাদিক শাহাবুদ্দিন ও ইসরাফিল সম্প্রতি দুর্গাপুরে পাওনা টাকা আদায়কে কেন্দ্র করে সংঘটিত এক সন্ত্রাসী হামলার বিষয়ে অনুসন্ধান চালান এবং তার প্রতিবেদন প্রকাশ করেন জাতীয় দৈনিক অগ্রযাত্রা প্রতিদিন-এ।

প্রতিবেদনে উল্লেখিত সন্ত্রাসী চক্র ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সংবাদ প্রকাশের অপরাধেই তাঁদের ওপর এ হামলা চালানো হয়। এক কথায়, পেশাগত দায়িত্ব পালনের অপরাধেই তাঁদের রক্তাক্ত করা হয়েছে।

সাংবাদিক শাহাবুদ্দিন বলেন, “আমরা কারও ব্যক্তিগত আক্রোশে সংবাদ করিনি। কেবল সত্য তথ্য জনসমক্ষে আনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারই জন্য আজ প্রাণ নিয়ে পালাতে হচ্ছে।” ইসরাফিলের কণ্ঠে ছিল হতাশা আর ক্ষোভ—”এটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। আমাদের হত্যার জন্যই নির্জন মাঠে নিয়ে গিয়েছিল।”

দুর্গাপুর থানার অফিসার ইনচার্জ দুরুল হুদা জানান, “এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দুজন হামলাকারী আটক হয়েছে। বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে। সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা হবে এবং কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।”

ঘটনার পর পাঁচুবাড়ি এবং আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “যদি সাংবাদিকদেরও হামলার শিকার হতে হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? যারা সত্যের পক্ষে দাঁড়ায়, তাদের যদি এভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সমাজ অন্ধকারে ডুবে যাবে।”
সাংবাদিক সমাজের প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র।

রাজশাহী অনলাইন সাংবাদিক ফোরামের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মানিক হোসেন বলেন, “সাংবাদিকদের ওপর হামলা মানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত। আমরা দ্রুত হামলাকারীদের বিচার চাই। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।” বিভিন্ন গণমাধ্যম সংগঠনও বিবৃতি দিয়ে বলেছে, “সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দোষীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, নইলে এই ধরনের হামলা বাড়তেই থাকবে।”

সুশীল সমাজ মনে করছে, দুর্গাপুরের এই ঘটনা দেশের মফস্বল সাংবাদিকতার নাজুক বাস্তবতাকে আবারও নগ্ন করে তুলেছে। বড় শহরের তুলনায় মফস্বলে কাজ করা সাংবাদিকরা অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। তাঁদের নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, নেই কোনো স্থায়ী আয় নিশ্চিত ব্যবস্থা। অনেক সময় রাজনৈতিক শক্তি, অপরাধী চক্র ও সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে সাংবাদিকদের নিরুপায়ভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাঁদের ওপর হামলা হলে আইনি সহায়তা পাওয়া কঠিন হয়, বিচারও বিলম্বিত হয় অথবা হয়নি।

বিভিন্ন গবেষণা বলছে, গত কয়েক বছরে দেশে মফস্বল সাংবাদিকদের ওপর হামলা, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে যায়, ফলে বিচার হয় না। এর ফলে সাংবাদিকদের মধ্যে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, যা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

সাংবাদিকতা শুধু পেশা নয়, এটি জনগণের জানার অধিকার রক্ষার অন্যতম মাধ্যম। যখন সাংবাদিকরা হামলার শিকার হন, তখন আসলে জনগণের তথ্য জানার অধিকারকেই আঘাত করা হয়। দুর্গাপুরের ঘটনায় সেটাই স্পষ্ট হয়েছে। তথ্য প্রকাশের অপরাধে যদি সাংবাদিকদের এমন নির্যাতনের শিকার হতে হয়, তাহলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কোথায়?

এ কারণেই এখন সময় এসেছে সাংবাদিক সমাজ, সুশীল সমাজ এবং সাধারণ জনগণকে একসঙ্গে সোচ্চার হওয়ার। সাংবাদিকদের ওপর যেকোনো হামলার বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করতে হবে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষায় রাষ্ট্রকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।

পাঁচুবাড়ির রক্তাক্ত বিকেল শুধু একটি হামলার গল্প নয়, এটি বাংলাদেশের মফস্বল সাংবাদিকতার এক করুণ চিত্র। যেখানে তথ্য প্রকাশের সাহসিকতাকে জবাব দেওয়া হয় লাঠির আঘাতে, ক্যামেরা ভেঙে, মোটরসাইকেল ছিনিয়ে। কিন্তু সব বাধা পেরিয়েও সাংবাদিকরা থেমে যান না। তাঁরা আবার উঠে দাঁড়ান, কলম হাতে নেন, ক্যামেরা চালু করেন। কারণ তাঁরা জানেন, সত্য প্রকাশের যুদ্ধ থামলে সমাজও থেমে যাবে।

আর তাই দুর্গাপুরের সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় একটাই বার্তা ছড়িয়ে পড়ছে— “হামলা করে সত্যকে দমিয়ে রাখা যাবে না। সাংবাদিকরা জীবন দিয়ে হলেও সত্যের পক্ষে থাকবেন।”