ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ(টিআইবি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ৫ আগষ্ট ২০২৪ হতে ০৪ আগষ্ট ২০২৫ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি, মানবাধিকার , অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা , স্বাস্থ্য, শিক্ষা,বিদ্যুত ও জ্বালানি ,কর্মসংস্থান, দুর্নীতি প্রতিরোধ, অর্থ পাচার,বিচার , সংস্কার, সুশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্র বিশ্লেষণপূর্বক প্রতিবেদন আজ সকাল ১১টায় ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারের প্রকাশ করা হয়।

প্রতিবেদনের প্রেক্ষাপটে বলা হয়,সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ঘটনা প্রবাহে নজিরবিহীন সহিংসতা, রক্তপাত ও ত্যাগের বিনিময়ে ৫ আগষ্ট ২০২৪ কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন ঘটে।০৮ আগষ্ট ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যভার শুরু হয়।

কর্তৃত্ববাদী সরকার পতনের পর ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা -আইনের শাসন, দুর্নীতি মুক্ত ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র ও প্রশাসন, রাজনৈতিক ও নির্বাচনী কাঠামো সংস্কার,খাত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানকে কেন্দ্র করে সময়ের ধারাবাহিকতা ও উদ্ভুত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য হলোঃ
০১) ন্যায়বিচার-বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও তার পূর্বে সংঘটিত অপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার।
০২) সংস্কার - রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক ও নির্বাচনী কাঠামো, বিভিন্ন খাত ও প্রতিষ্ঠান ।
০৩) নির্বাচন -দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।

গবেষণা প্রতিবেদনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো কর্তৃত্ববাদী সরকার পতনের এক বছরের ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করা। সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হলো (০১) বিচার, সংস্কার, নির্বাচন,সরকারি কার্যক্রম, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত কার্যক্রম পর্যালোচনা করা (০২) বিভিন্ন অংশীজনের ভূমিকা পর্যালোচনা করা এবং (০৩) অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ সুশাসনের নির্দেশকের আলোকে চিহ্নিত করা।

টিআইবি তার লিখিত প্রতিবেদনে জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যবেক্ষণে বলেন, ছাত্র জনতার ওপর হামলাকারী, হত্যার ইন্ধনদাতা ও নির্দেশদাতাদের বিরুদ্ধে সারাদেশে দায়েরকৃত মামলা সংখ্যা ১৬০২টি(হত্যা মামলা ৬৩৮টি)। পতিত সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য গ্রেফতার ৮৭ জন(১জুন২০২৫ পর্যন্ত)।৭০ শতাংশ মামলার সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়েছে এবং ৬০-৭০টি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে (৩জুন ২০২৫ পর্যন্ত)।গণহত্যায় জড়িত বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৭৬১টি,আসামী ১১৬৮ জন এর মধ্যে গ্রেফতার ৬১জন(৮জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত)। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত অভিযোগ ৪২৯টি ও মামলা ২৭টি,শেখ হাসিনাসহ আসামী ২০৬ জন এবং গ্রেফতার ৭৩ জন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করায় রাজনৈতিক দলের বিচার করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অভিযুক্তের গোপণে দেশত্যাগ, দেশত্যাগে সেনাবাহিনী, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে সহযোগিতার অভিযোগ উঠে এসেছে।
জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কমিশন মনে করে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ কীভাবে বাস্তবায়িত হবে তার কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা সরকারের নেই। এছাড়া, আলোচনা প্রক্রিয়ায় প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও শক্তিকে প্রাধান্য দেওয়ার অভিযোগ আছে। জাতীয় সংসদে নারী আসন (১০০টি) নিয়ে যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে তার ফলে নারীদের কার্যকর প্রতিনিধিত্বের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতা ও বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে।

আইনি সংস্কারের ক্ষেত্রে আইসিটি আইন সংশোধনের মাধ্যমে বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে।বিতর্ক বা প্রতিবাদের মুখে বারবার আইন সংশোধনের ফলে আইন/নীতি প্রণয়নকারী এবং সংশ্লিষ্ট আইনের ওপর পরিচালনাকারীদের অনাস্থা তৈরির ঝুঁকি বিদ্যমান রয়েছে।

বিচারিক সেবা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে সাবেক সরকারের আমলে দায়েরকৃত মামলা ও রায় থেকে অব্যাহতি,দন্ড মওকুফ, মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা,আদালতে বিচারক, আইনজীবী,বাদী-বিবাদীর নিরাপত্তা প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়।

টিআইবির সার্বিক গবেষণা পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে যে,
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নজিরবিহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অসামান্য অর্জন। রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ গড়ার অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং এই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় অন্তবর্তীকালীন সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন অংশীজনদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বহুবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এক বছরে বিচার, সংস্কার, নির্বাচন, রাষ্ট্র পরিচালনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলেও বাস্তবায়নে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর অর্পিত দায়িত্ব তথা বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার এবং নির্বাচনের সুস্পষ্ট ও সুপরিকল্পিত কৌশল ও রোডম্যাপ প্রনয়ন ও প্রকাশ না করার ফলে সরকারের উপর বিভিন্ন অংশীজনের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে এডহক প্রবণতা; প্রশাসন পরিচালনায় অনেক ক্ষেত্রে সরকারের দৃঢ়তা ও কর্মপরিকল্পনার 
 ঘাটতি; সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বশীলদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা;কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পরিবর্তনও করা হয়। পুলিশ প্রশাসনসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অস্থিরতা, নতুন রাজনৈতিক বলয় তৈরির প্রয়াস এবং ব্যাপক রদবদলের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক অকার্যকারিতা - এ সকল ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতা দৃশ্যমান। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ ভিতর থেকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।তথ্য প্রকাশ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এখানো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির বিকাশ ও প্রভাব দৃশ্যমান হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতা ও বলপ্রয়োগের কারণে জেন্ডার, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে যা বৈষম্য বিরোধী চেতনার সাধে সাংঘর্ষিক প্রতীয়মান। রাষ্ট্র সংস্কারের মৌলিক ক্ষেত্র সমূহে বেশিরভাগ বিষয়ে বড় দল ও সহযোগীদের ভিন্নমত "নোট অফ ডিসেন্ট" সাপেক্ষে জুলাই সনদে ঐকমত্য বিবেচিত হওয়ায় কর্তৃত্ববাদী চর্চা বাস্তবে প্রতিহত করা সম্ভব হবে-এমন প্রত্যাশার পথ দূরহ।
সংবাদ সম্মেলনে সমাপনী বক্তব্যে ও প্রশ্নোত্তর পর্বে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ডঃ ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের আশা আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে বর্তমান সরকারের আন্তরিকতা দেখা গেলেও সামর্থ্যের ঘাটতি রয়েছে। সংসদে ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলে রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যে ঐক্য একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত।তাছাড়া, বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় গঠন, নির্বাচন কমিশন গঠনে স্বাধীন সংসদীয় কমিশন গঠন, সরকার প্রধানের ক্ষমতা হ্রাস,পিআর পদ্ধতিতে সংসদের  উচ্চকক্ষে আসন বন্টনের মতো সুশাসন নিশ্চিতকরণ উপযোগী সিদ্ধান্তগুলো নিঃসন্দেহে জাতীয় অগ্রগতি।এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন অভ্যুত্থানের পরে গঠিত নতুন দল এনসিপি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করলেও মাঠ পর্যায়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের অনুসারীরাও চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও তদবির বাণিজ্যে জড়িয়ে পরেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মোহাম্মদ জুলকারনাইন,শাহজাদা এম আকরাম, টিআইবির এডভাইজার অধ্যাপক ডঃ সুমাইয়া খায়ের, টিআইবির পরিচালক মোহাম্মদ বদিউজ্জামান ও মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।