৩৬ জুলাই—এই দিনটি আজ আর শুধুই একটি তারিখ নয়, বাঙালির ইতিহাসে রক্তাক্ত গৌরব আর জনতার বিজয়ের প্রতীক। দীর্ঘ ১৭ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটানো এই দিনটি হয়ে উঠেছে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়, যেখানে লাখো নয়—কোটি মানুষ রাজপথে নেমে এনে দেয় ইতিহাসের মোড় ঘোরানো এক বিপ্লব। সেদিন লন্ডভন্ড হয়ে যায় শেখ হাসিনার দীর্ঘকালীন দমন-পীড়নমূলক ক্ষমতা। গণভবনের মসনদ থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। স্বৈরাচার পতনের সেই দিনটি স্মরণে ইতিহাস আজও কাঁপে।

৩৬ জুলাইয়ের সকালটা ছিল ভিন্ন। অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি থমথমে, অনেক বেশি আতঙ্কে ঢাকা ছিল চারপাশ। কারফিউ জারি করা হয়েছিল আগের রাতেই। তবু বাঙালি ঘুমায়নি। রাজধানীর পথে পথে টান টান উত্তেজনা। শহরের প্রবেশমুখে দেখা যায় লাখো মানুষের ঢল। তারা এসেছিল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। এসেছিল দলবদ্ধভাবে, পতাকা হাতে, গলা ফাটানো স্লোগান নিয়ে—"স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক!"

যারা তরুণ, যারা বৃদ্ধ, নারী, শিশু—সবাই সেদিন একক কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছিল, আর নয়। শেখ হাসিনার দমননীতি, কোটা বৈষম্য, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন আর গুম-খুনের বিরুদ্ধে তারা দিয়েছে সর্বোচ্চ ত্যাগ। কারফিউ ভেঙে হাজার হাজার মানুষ শহরে ঢুকতে থাকে। রাজপথে তখন প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধ। পুলিশের গুলি, টিয়ার শেল, জলকামান কিছুই আটকাতে পারেনি মানুষের পদচারণা। শহরের মোড় থেকে মোড়, অলিগলি থেকে রাজপথ—সব কিছু ভরে যায় বিপ্লবের আগুনে।

সকাল থেকে শুরু হওয়া প্রতিরোধ দুপুর নাগাদ রূপ নেয় বিজয়ের আনন্দে। সেনাবাহিনীর একাংশ তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মাঠে নামে। কিন্তু তারা গুলি ছোড়েনি। বরং জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে। দুপুর ২টা ২০ মিনিটে রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ব্রেকিং নিউজ হিসেবে জানায়—সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে গুজব: হাসিনা দেশ ছেড়েছেন।

বেলা আড়াইটার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা আসে—শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করেছেন এবং ভারত হয়ে দুবাইয়ের উদ্দেশে দেশত্যাগ করেছেন। এই ঘোষণার পর ঢাকার আকাশে পতপত করে উড়তে থাকে বিজয়ের পতাকা। গণভবনের ফটকে উঠে যায় “জনতার দখলে” লেখা ব্যানার। হাজারো জনতা সেখানে পৌঁছে উল্লাসে ফেটে পড়ে। রাজপথে তখন আনন্দাশ্রু আর বিজয়গাথা।

বিজয়ের আনন্দের দিন হলেও ৩৬ জুলাই ছিল একই সঙ্গে এক বেদনাবিধুর অধ্যায়। কারণ এই বিপ্লব বিনা রক্তে হয়নি। সেদিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন বহু মানুষ। শুধু ঢাকাতেই প্রাণ হারান ১৯ জন। দেশব্যাপী এ সংখ্যা ৮০ ছাড়ায়। আহত হন হাজারেরও বেশি মানুষ। চিকিৎসার অভাবে অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান। মায়েদের কোল খালি হয়েছে, সহপাঠীরা হারিয়েছে প্রিয় বন্ধুকে। এই শহীদদের রক্তের মধ্য দিয়েই রচিত হয় নতুন দিনের সূচনা।

এই বিপ্লবের বীজ বোনা হয় আরও আগে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন এক প্রজন্ম প্রশ্ন তোলে—রাষ্ট্র কার? চাকরি, সুযোগ ও নিরাপত্তা কেন শুধু এক শ্রেণির জন্য বরাদ্দ থাকবে? ধীরে ধীরে আন্দোলন রূপ নেয় গণআন্দোলনে। শ্রমিক, নারী, দলিত, আদিবাসী, শিক্ষক, পেশাজীবী, এমনকি সাধারণ মানুষ—সবাই একত্র হয় বৈষম্যবিরোধী ঐক্যবন্ধনে।

বিপ্লবের দিন ঘনিয়ে আসে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে। আর ৩৬ জুলাই ছিল সেই বিস্ফোরণ, যে বিস্ফোরণ ক্ষমতার তাসের ঘরকে গুঁড়িয়ে দেয়।

শেখ হাসিনার পতনের পর দেশে গঠিত হয় ‘অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা পরিষদ’। জাতির প্রত্যাশা ছিল, এই প্রশাসন একটি বৈষম্যহীন, স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে। মূলধারার রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের জমে থাকা অনিয়ম, গোষ্ঠীতন্ত্র এবং পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে তা হবে একটি স্থায়ী বিকল্প। ৩৬ জুলাইয়ের সেই আশা এখন রাষ্ট্র পরিচালনায় পরিণত হয়েছে একটি ঐতিহাসিক লক্ষ্য।

৩৬ জুলাই আজ বাঙালির স্মৃতির ভেতরে গেঁথে থাকা সেই দিন, যেদিন লাখো শহীদের আত্মদান সফল হয়। স্বৈরাচারী সরকারকে পদচ্যুত করে জনতা বুঝিয়ে দেয়, ক্ষমতার উৎস জনগণ, ভয় নয়। জাতির সামনে এই দিন অনন্তকাল থাকবে সাহসের, ত্যাগের আর গণঅভ্যুত্থানের অনুপ্রেরণা হিসেবে।

এই বিজয় কেবল হাসিনার পতনের নয়, বরং জনগণের আত্মমর্যাদার জাগরণের প্রতীক। সেদিনের স্বপ্ন যেন পরিণত হয় বাস্তবে—এই হোক প্রত্যেক মুক্তিকামী মানুষের অঙ্গীকার।